বরাবর
সহ-সভাপতি
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
এলইডি ভবন, জাতীয় সংসদ ভবন
শেরে বাংলা নগর, ঢাকা
বিষয় : জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া (সংশোধনী) প্রসঙ্গে।
প্রিয় মহোদয়
শুভেচ্ছা জানবেন।
উপরে উল্লেখিত জাতীয় সনদ বিষয়ে ইতোপূর্বে লিখিতভাবে ও আলোচনার মাধ্যমে আমাদের মতামত জানিয়েছি। আপনাদের পাঠানো খসড়ায় তার যথাযথ প্রতিফলন হয়নি। এ বিষয়ে কিছু কথা জানাতে চাই।
(১) ২০২৪ এর ৫ অক্টোবর মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতির আমন্ত্রণে বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে উপস্থিত হয়ে আমাদের লিখিত মতামত উত্থাপন করি। ঐ সময় আলোচনায় ও পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে চলমান সংস্কার নিয়ে এই আলোচনা হয় যে, সংস্কার প্রস্তাবে সব দল ও অংশীজন মিলে যে সব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে শুধু এটুকুকে ঐক্যমত হিসেবে গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কোনো কোনো বিষয়ে ঊনিশ/বিশ পার্থক্য হলে- ঐ সব বিষয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্য না হলে তা দলের বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হবে।
(২) এসব বিবেচনা থেকে আমরা আন্তরিকভাবে আলোচনায় অংশ নেই এবং আমাদের মতামত তুলে ধরি। কয়েকটি বিষয়ে জোরাজুরির প্রেক্ষিতে এসব আলোচনা হয় যে, এখানে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দল, তাই আদর্শিক বিষযে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করা ভালো (যেমন: সংবিধানে বর্ণিত চার মূলনীতি)। বরং অন্যান্য সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে।
(৩) আলোচনার এক পর্যায়ে চার মূলনীতি বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরে, ঘোষণা দিয়ে সভা চূড়ান্তভাবে বর্জন করি। আরো কয়েকটি দলও সভা বর্জন করে।
(৪) ঐ সভা বর্জনের আগে অন্যান্য বিষয়ে, এমনকি সনদের ভূমিকা, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আমরা আমাদের মতামত লিখিতভাবে জানাই।
(৫) আমরা আশা করেছিলাম, সনদের পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া (সংশোধিত) পাঠানোর পূর্বে উল্লেখিত বিষয়ে, বিশেষত সংবিধানের মূলনীতি প্রশ্ন আলোচনার বাইরে রেখে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেসব বিষয়ে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপিত হবে।
এমনকি নোট অফ ডিসেন্ট দিয়ে যে ঐকমত্য করা হলে, তা ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন দূরূহ হয়ে পড়বে, সেসব বিষয়েও আমরা বলেছিলাম।
(৬) আমরা দেখলাম, আমাদের উল্লেখিত প্রস্তাবকে গুরুত্ব না দিয়ে এসব বিষয় পুনরায় উত্থাপিত হলো। এমনকি ইতোপূর্বে পাঠানো ভূমিকা ও বাস্তবায়ন বিষয়ে নতুন অনেক কথা সংযোজন করা হলো। যা এসব সামগ্রিক ঐক্যমতের ক্ষেত্রে আরো সংকট তৈরি করবে বলে মনে করি।
(৭) এরপরও সর্বশেষ পাঠনো খসড়া সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি।
ভূমিকার প্রথম প্যারার শেষ লাইনে ‘ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি’, বলা হয়েছে, এটা যথাযথ নয়, বলা উচিৎ ‘অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি’।
এছাড়া-
(ক) পটভূমিতে পাকিস্তানের জন্ম, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ, একপেশে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতির কথা বলা হয়নি। অবৈজ্ঞানিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ইতিহাস ১৯৫২, ১৯৫৮, ১৯৬৬-র আন্দোলন, ১৯৬৯ গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ যথাযথভাবে লেখা প্রয়োজন।
(খ) সংকট তৈরি হয়েছে ৫৩ বছর ধরে, এগুলো না বলে শুধুমাত্র একটা সময়ের কথা বলা হয়েছে। কিছু বিশেষ সময়ের সংকটের কথা বলা হয়েছে, এটা একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য। এটাকে গ্রহণযোগ্য করতে পুনর্লিখন করতে হবে।
পটভূমির শেষ প্যারায় দ্বিতীয় লাইনে ‘সংবিধানের মৌলিক সংস্কার’ এর স্থলে সংবিধানের অসম্পূর্ণতা দূর করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ... বলা যথার্থ মনে করি।
(গ) ঐকমত্য কমিশন গঠন, কমিশন কার্যক্রম ... এত বিস্তারিত লেখা অপ্রয়োজনীয়। এছাড়া ঐকমত্য না বলে কোনো কোনো বিষয়ে ঐকমত্য বলা যথার্থ হবে।
(ঘ) ঐকমত্যে উপনীত বিষয়সমূহ হিসেবে ৮৪টি বিষয় বলা হয়েছে। এটা যথার্থ নয়। ৮৪ বিষয়ের বেশ কয়েকটিতে আমাদের বক্তব্য যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ ও উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া দেখতে পেলাম, সব বিষয়ে সব দলের ঐকমত্য নাই, তাই এসব বিষয় ঐকমত্য বলা মোটেই ঠিক না।
আইন সভা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন অধ্যায়ে বর্ণিত সব বক্তব্যের সাথে আমরা একমত নই। আলোচনায় আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলাম। দেখলাম আমাদের দ্বি-মতগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি।
(ঙ) এগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার নীতি প্রশ্নে কোনো ছাড় দিয়ে ঐক্যমত সম্ভব নয় বলে আমরা এগুলোকে আলোচনার বাইরে রাখার কথা বলেছিলাম। এজন্য আমরা কমিশনের সভা চূড়ান্ত বর্জন করেছিলাম। অথচ এরপরও আমাদের সাথে কথা না বলে প্রকারান্তরে ওই চার মূলনীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের সম্মতি নেওয়ার কথাই বলা হয়েছে- যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এভাবে উল্লেখ থাকলে আমাদের পক্ষে এই সনদের পক্ষে থাকা অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। মূলনীতি প্রশ্ন বাদ রাখা তাই আবশ্যক।
(চ) সংবিধান সংশোধনে গণভোট, ৭(ক), ৭(খ), ১৫০(২), ৬ষ্ঠ ও ৭ম তফসিল বিলুপ্তি ও সংবিধানে না রাখার সাথে আমরা একমত নই।
(ছ) নারী আসন বিষয়ক প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত নই। এটাও আলোচনা থেকে বাদ রাখা দরকার বলে মনে করি।
(জ) এখন দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
(ঝ) সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টি চূড়ান্ত করা প্রয়োজন।
(ঞ) মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সম্প্রসারণের বিষয়ে তালিকা সংশোধন নয় সম্প্রসারণ করা এবং এসব বিষয় সুনির্দিষ্ট করার কথা আমরা বলেছি।
(ট) বলা হয়েছে, জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বিধান প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক-আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটি একটি চরম অগ্রহণযোগ্য বিষয়।
সংবিধান পরিবর্তনের আগে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হচ্ছে এবং আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে হচ্ছে! এটি কি করে সম্ভব? এসব বক্তব্য সনদকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। এটা একেবারেই বাদ দেওয়া জরুরি।
(ঠ) অঙ্গীকারে বলা হচ্ছে, এই সনদে যা আছে সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, বিদ্যমান সংবিধানে অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেক্ষেত্রে সনদের বিধান প্রাধান্য পাবে। সংবিধানের ঊর্ধ্বে এভাবে বিবেচনার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
মনে রাখা দরকার এই সনদ বা কমিশনের যেকোনো সিদ্ধান্ত সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর কোনটি আইন হিসেবে বিবেচিত হয় না। তাই এই প্রস্তাবে কোনো বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যার জন্য আপিল বিভাগের উপর ন্যস্ত করার সুযোগ নাই। কমিশনের কোনো এখতিয়ার নাই আদালতে অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করে দেওয়ার।
সেই সাথে এরকম কোনো সনদকে আদালতের এখতিয়ারের ঊর্ধ্বে রাখারও কোনো সুযোগ নাই। এই সনদে যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন দেশের যে কোনো নাগরিক এই সনদের কোনো অংশ নিয়ে দেশের যে কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলতে পারবেন কিনা সে বিষয়টি সংবিধান ও আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এমনকি জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার কোনো আইনেও যদি আদালতের এখতিয়ার সীমিত বা রহিত করা হয়, সেটাও ক্ষেত্রমতে আদালত উপেক্ষা করতে পারে।
(ড) সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত পরামর্শ আমরা দিতে পারি, এর বেশি নয়। আমরা দেখলাম এখানে সংবিধান সংশোধনের সাথে সাথে পুনর্লিখনের কথাও বলা আছে। অনেকে সংবিধান পুনর্লিখন করতে চান। তাদের সাথে আমরা নেই। এটা গ্রহণ করা যায় না। এখানে পুনর্লিখন শব্দ বাদ দিতে হবে।
(ঢ) প্রথমে আমাদের কাছে পাঠানো খসড়ায় দেখেছিলাম, সংবিধান সংশোধন বিষয়ক আমাদের পরামর্শ আগামী জাতীয় সংসদ দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করবে। এবার দেখলাম এমনভাবে লেখা হয়েছে যে, তাতে মনে হয় বর্তমান সরকারকে দিয়েই এসব কাজ সম্পন্ন করা হবে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সংবিধান সংশোধনের অধিকার, জনগণের সম্মতি নিয়ে একমাত্র নির্বাচিত সংসদের। যা সংবিধানে বর্ণিত আছে। আগামীতে নির্বাচিত সংসদ সে বিষয়ে ভূমিকা পালন করবে।
সবমিলিয়ে মনে হয়েছে, এখানে কোনো কোনো গোষ্ঠীর বয়ানকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা ঐকমত্যকে বাধাগ্রস্ত করবে।
শুরুর কথা পুনরাবৃত্তি করে আবারো বলতে চাই, ঐকমত্যের অর্থ হবে যে বিষয়ে আমরা শতভাগ একমত হয়েছি। আর এগুলো বাস্তবায়ন করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট। প্রস্তাবিত বক্তব্যে কমিশন অনড় থাকলে আমাদের পক্ষে এবং আমাদের ধারণা সব দলের পক্ষে এ বিষয়ে সম্মতি দেওয়া সম্ভব হবে না।
আমরা আশা করবো ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দের দীর্ঘ পরিশ্রম ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনায় সর্বসম্মতিতে ঐকমত্যের বিষয়গুলো নিয়ে ‘সনদ’ তৈরি করা হবে এবং অন্যান্য বিষয় যার যার দলের বক্তব্য হিসেবে তুলে ধরা হবে।
অঙ্গীকারপত্রে পূর্বেকার খসড়ার পাঠানো বক্তব্য ও আমাদের মতামত বিবেচনা করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে গঠিত সরকার আগামী ২ বছরের মধ্যে ঐকমত্যের প্রণীত সনদের সুপারিশ বাস্তবায়নে নিয়মানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এখানে বাস্তবায়নের সময়সীমা আলোচনা করে পুনঃনির্ধারণ করা যেতে পারে।
এর বাইরে অন্য কোনো পদ্ধতি অনৈক্য তৈরি করবে এবং ঘোষিত সময়সীমায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও অনিশ্চিত করে তুলবে।
আশা করি, সনদে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমিশন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।