বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আয়োজিত সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই মাস পার হতে চলল অথচ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো খবর নেই, সিন্ডিকেট বহাল আছে। উৎপাদক ও ক্রেতার স্বার্থে দীর্ঘদিনের দাবি “উৎপাদক সমবায় ও ক্রেতা সমবায়” গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। বরং লাগামহীন নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষ দিশেহারা। অন্যদিকে দাবির কথা বলতে গিয়ে শ্রমিকের রক্ত ঝরছে। সার কীটনাশকের দাম বেড়ে গেছে। কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কৃষক ক্ষেতমজুরের স্বার্থে কোনো আলোচনাই দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নিয়ে আলোচনা নেই কোথাও। অথচ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দাবির কাছে সরকার নতজানু হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় এসব অপশক্তি দাপট দেখাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে এরা জেঁকে বসছে। পতিত স্বৈরাচারের হাত থেকে সর্বত্র দখলমুক্ত হয়নি। অনেক জায়গায় এক দখলদারের পরিবর্তে আরেক দখলদার জায়গা করে নিচ্ছে। জনজীবনের শান্তি ফিরে আসেনি।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারও মানুষের রক্ত দেওয়া ও হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ এবং কোটি মানুষের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এসব ঘটনায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রকৃত অপরাধীদের এখনো গ্রেফতার করা হয় নাই। বরং অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা দিয়ে, মূল ঘটনাকে হালকা করে ফেলা হচ্ছে। বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিচার ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নেতৃবৃন্দ বিশেষ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য যথাযথ উদ্যোগের দাবি জানান।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা প্রথম দিন থেকেই বলে এসেছি, এই আন্দোলনে কোনো দল বা গোষ্ঠী জয় লাভ করে নাই। জয় লাভ করেছে দেশের মানুষ।
তাই এসব মানুষের স্বার্থেই ভূমিকা নিতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে দল নিরপেক্ষ যোগ্য দক্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে। এমন কড়া বার্তা দিতে হবে যে, কেউ যদি দখলদারিত্ব কায়েম করে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সরকারের কাছ থেকে এ কাজটি এখনও পর্যন্ত আমরা দেখলাম না। বরং আমরা দেখলাম, দীর্ঘদিনের আন্দোলনকারী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ব্যক্তি এবং সংগঠককে উপেক্ষা করে বিশেষ কতক গোষ্ঠীর স্বার্থেই সরকার তার কাজ পরিচালনা করছে।
নেতৃবৃন্দ এই অবস্থার অবসান ঘটাতে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে অর্থবহ আলোচনা করে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য কতক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের রূপরেখা তৈরি ও নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের আলোচনা শুরু এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান।
শ্রমিক হত্যার বিচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, রেশন ব্যবস্থা চালু, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে জনজীবনে শান্তি, সর্বত্র সম্প্রীতি রক্ষা, দুর্নীতি-লুটপাট-দখলদারিত্ব বন্ধ, পাচারের টাকা-খেলাপী ঋণ আদায়, শ্রমিকের জাতীয় ন্যূনতম মজুরি, কৃষক-ক্ষেতমজুরের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন, সবার জন্য কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য-শিক্ষার নিশ্চয়তা, কালাকানুন আইন বাতিল, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন প্রবর্তন, নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারসহ গণতান্ত্রিক সংস্কারের আলোচনা শুরু, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার ও সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী আগ্রাসন রুখে দাঁড়ানোর দাবিতে আজ ৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আয়োজিত সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, সদস্য কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, জলি তালুকদার, ডা.
সাজেদুল হক রুবেল প্রমুখ।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ দেশের সর্বত্র ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান এবং নির্বিঘ্নে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা দিতে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এজন্য এলাকায় এলাকায় সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ সময়ে কেউ যদি অপতৎপরতা করার দুঃসাহস দেখায় তাদের চিহ্নিত ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
নেতৃবৃন্দ ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে জলজট-যানজটের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অতীতের শাসকরা উন্নয়নের নামে জনগণকে সম্পৃক্ত না করে সংকট হলেই এক একটা প্রজেক্ট নিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করেছে। এ সময় তারাতো ক্ষমতাই নেই। এই সরকার এসব সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করতে পারবে- সেটি আমরা আশা করি না। তবে এসব সংকট সমাধানের কার্যক্রম শুরু হলো না কেন? আমরা এটা জানতে চাই।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, পাচারের টাকা ফেরত আনা, খেলাপী ঋণ আদায়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি জনগণ দেখছে না। বিগত দিনের সরকার মুক্ত বাজারের নামে লুটপাটের ধারায় এই অর্থনীতি পরিচালনা করেছে। তারই অনিবার্য পরিণতি ছিল এই দুর্নীতি-লুটপাট, আর দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি। নেতৃবৃন্দ এই লুটপাটের ধারার অর্থনীতি পরিবর্তন করে দেশ ও মানুষের স্বার্থে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন অর্থনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
সমাবেশে নেতৃবৃন্দ গণঅভ্যুত্থানর ফসল যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য আন্দোলনকারী শক্তি ও দেশবাসীকে সজাগ থেকে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম অগ্রসর করার আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুরানো পল্টনস্থ পার্টি কার্যালয় এসে শেষ হয়।
উল্লেখ্য, আজ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আগামীকালও অনেক জেলায়-উপজেলায় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।