
ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে দেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। এই অগ্রগতির প্রধান কারিগর ও নায়ক হলো দেশের কৃষক-ক্ষেতমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ শ্রমজীবী জনগণ, প্রবাসে কর্মরত মেহনতি মানুষ ও ক্ষুদে-মাঝারি উদ্যোক্তাগণ। দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ও শাসকগোষ্ঠীর গণবিরোধী কার্যকলাপ সত্ত্বেও এই অগ্রগতি যে সম্ভব হয়েছে, তা এ দেশের মজুর-কিষান ও আপামর জনগণের অপার সৃষ্টিক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও দেশপ্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতে এলে, এ দেশ যে অসাধ্য সাধন করতে পারবে-এটি তারই প্রমাণ।
কিন্তু এই অগ্রগতি সত্ত্বেও সামগ্রিক বিবেচনায় এ কথা বলতে হয় যে, দেশে আজ বিরাজ করছে এক অব্যাহত রুগ্ণতা ও সংকটের আবর্ত। সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে লুটেরা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুঁজিবাদী সংশ্লেষণের আরো বিস্তৃতি ঘটে চলেছে। গত ৪ দশক ধরে চলতে থাকা ‘সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা-ধনবাদের’ একই পথে দেশ আজও পরিচালিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, লুটপাটতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতা এখন দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ রূপে বিরাজ করছে। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেশ আবদ্ধ হয়ে আছে এক স্থিতাবস্থায়। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির বিপজ্জনক পশ্চাদ্গমনও ঘটেছে। বস্তুত দেশের আরো দক্ষিণপন্থী অধোগতি ঘটেছে। প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক জঙ্গি অপশক্তি সম্প্রতি কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হলেও এবং কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও দণ্ড কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও, এসব অপশক্তি তাদের সামাজিক ভিত্তি তৃণমূলে প্রসারিত করতে শুরু করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটে চলেছে। তা সত্ত্বেও এসবের প্রধান হোতা জামায়াত এবং অনুরূপ অপশক্তিকে এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। অথচ ভোটাধিকারসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে পরিকল্পিতভাবে খর্ব করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘অবাধ বাজার অর্থনীতি’র দর্শন অনুসরণের ফলে রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে পণ্যায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ, ভোগবাদ, প্রদর্শনবাদ ইত্যাদি আরো গভীরে বিস্তার লাভ করছে। সম্পদ-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যা-সংকটগুলো নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিস্তৃত হচ্ছে। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতিতে বিপজ্জনক দুর্বৃত্তায়ন ঘটায় সামাজিক নৈরাজ্যের বিপদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-হামলা বাড়ছে। পরিবেশ-প্রকৃতির বিরুদ্ধে আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। দেশ আরো শক্তভাবে সাম্রাজ্যবাদের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা এবং রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে দেশ এখনও অনেক দূরে সরে এসেছে। বরং অনেক ক্ষেত্রে তার বিপরীতমুখী প্রবণতা জোরদার করা হচ্ছে। এসবই হলো লুটেরা-বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াশীলতা ও চরম ব্যর্থতা-দেউলিয়াপনার নিদর্শন।
গোটা বিশ্বেও নানা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার অভিঘাত আমাদের দেশের ওপরেও এসে পড়ছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রান্তস্থিত অবস্থানের কারণে আমাদের দেশ ব্যাপকভাবে হয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য
সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী দেশ ও শক্তির অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার অনুগামী ও ক্রীড়নক।
দশম পার্টি-কংগ্রেসের পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কার্যত একতরফা ও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ‘নির্বাচনের’ মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সহিংস সন্ত্রাস, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি দ্বারা একটি ‘পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করে যেনতেন উপায়ে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটানোর যে ষড়যন্ত্র করেছিল, সে রাজনৈতিক ‘জুয়া’ খেলায় তারা ব্যর্থ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এই ষড়যন্ত্রের খেলাকে চতুরতার সঙ্গে মোকাবেলা করে এবং ‘অনেকটা খালি মাঠে গোল দেওয়া’র পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘জিতে আসা’র ব্যবস্থা করেছিল। অন্যান্য আসনে নির্বাচনের নামে পরিচালিত হয়েছিল প্রহসন। এভাবে আওয়ামী লীগ একটি নিয়ম রক্ষার, কিন্তু নৈতিক ও গণতান্ত্রিক বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য, প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছিল। তার পর থেকে দেশে গণতন্ত্রের ভিত্তি ক্রমাগত আরো দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে চলেছে। আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতা অব্যাহত আছে। জনগণের সমর্থনের বদলে, রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তিকে দলীয়ভাবে
ব্যবহার করে এবং বিদেশি আশীর্বাদকে অবলম্বন করে বর্তমানে সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এসব শক্তি যদিও তাকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু কে কখন ক্ষমতায় থাকবে বা থাকবে না-সে বিষয়টি এখন এসব শক্তির মর্জির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এর ফলে, ওপরে ওপরে সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলে জাহির করা হলেও, ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তা-অস্থিতিশীলতার উপাদানগুলো ক্রমেই বেড়ে উঠছে।
কমিউনিস্ট পার্টির সামনে কর্তব্য হলো, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কী কর্মকৌশল নিয়ে অগ্রসর হলে দেশের শ্রমজীবী মানুষ তথা জনগণের স্বার্থকে সে যথার্থভাবে এগিয়ে নিতে পারবে, তা নির্ধারণ করা। পার্টির সামনে কর্তব্য হলো, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধনের মূল রণনৈতিক কর্তব্যকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পার্টির আশু কর্মকৌশল স্থির করা।
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি
বিভিন্ন দিক থেকে গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি বর্তমানে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র কর্তৃত্বে যেভাবে একটি ‘এককেন্দ্রিক বিশ্বের’ উদ্ভব ঘটেছিল এবং ‘সমাজতন্ত্রের কবর হয়ে গেছে’ বলে যেভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সে অবস্থা থেকে বিশ্বপরিস্থিতি এখন অনেকটা দূরে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখন ‘সমাজতন্ত্রী’ পরিচয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন আর্থিক ও সামরিক শক্তি যদিওবা এখনও একক শীর্ষ স্থানে রয়েছে, তথাপি তার সেই একক আধিপত্য আজ বিভিন্ন দিক থেকে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ছে। চীন এখন অনেক ক্ষেত্রে মার্কিন শক্তি-সামর্থ্যরে সমতুল্য হওয়ার পথে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। মার্কিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে নতুন নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও জোট গড়ে উঠছে। বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে রাশিয়া মার্কিন অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীনভাবে সরাসরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে এক ধরনের স্ট্র্যাটেজিক মৈত্রী গড়ে উঠছে। এই দুটি দেশের সঙ্গে ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশ একত্রিত হয়ে কতক ক্ষেত্রে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণের ফলে, মার্কিন আধিপত্যের একচেটিয়াত্ব এখন আর প্রশ্নাতীত বিষয় হয়ে থাকতে পারছে না। পুঁজিবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেও শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম শক্তিশালী হচ্ছে এবং র্যা ডিকাল রূপ ধারণ করছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘রাজনৈতিক বিপ্লবের’ আহ্বান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে। কিন্তু এসব ঘটনা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, এখনও বিশ্বের প্রধানতম নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হয়ে আছে। এই নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা যেন অব্যাহত রাখা যায়, সেজন্য সে আরো মরিয়া হয়ে গোটা বিশ্বে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে চলেছে। এভাবে, দেশে দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির ক্রমবর্ধমান মেরুকরণ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতি বিস্তৃত হচ্ছে এবং তা বিশ্বের বিশৃঙ্খল ও টালমাটাল অবস্থাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।
২০০৮ সালে বিশ্বপুঁজিবাদী অর্থনীতি স্মরণকালের যে ভয়াবহতম সংকটে নিমজ্জিত হয়েছিল, তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী কতকগুলি গণবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল লোকসানি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির লোকসান কাটানোর জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক উদার সাহায্য প্রদান এবং সেই অর্থ সংগ্রহের জন্য রাষ্ট্রের সামাজিক ব্যয়ের সংকোচন। এই কর্মসূচিরই অপর নাম ‘বেইল আউট’ কর্মসূচি অর্থাৎ ‘মুনাফার ব্যক্তিগতকরণ এবং লোকসানের সামাজিকীকরণে’র কর্মসূচি। এই গণবিরোধী পদক্ষেপের ফলাফল মার্কিন জনগণ মুখ বুজে গ্রহণ করেনি। এসব পদক্ষেপের ফলে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের তীব্রতা খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কিছুটা কেটে গেলেও, সেখানে সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সূচিত হয়েছে নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক গণআন্দোলন। এগুলো হলো আসলে শ্রম ও পুঁজির মৌলিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ।
শিক্ষা-স্বাস্থ্য বাজেটের কর্তন, মজুরি হ্রাস, পেনশন-ফান্ডের সংকোচন, শ্রমিক ছাঁটাই-সম্প্রতি এসবের বিরুদ্ধে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে আন্দোলন তীব্রতর হয়েছে। আন্দোলনের শক্তিগুলি ‘ওয়াল স্ট্রিট দখলের’(Occupy Wall Street) এবং ‘ধনী ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বাকি ৯৯ শতাংশের’ সংগ্রামের স্লোগান তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘণ্টাপ্রতি ১৫ ডলার ন্যূনতম মজুরির দাবিতে ‘১৫ ডলার আন্দোলন’ সূচিত হয়েছে। বিশ্বপুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্পদ ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করে তা এক
বিপজ্জনক মাত্রায় উপনীত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের মাত্র ৬৬টি ধনী পরিবারের হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের নিচের ৫০ শতাংশের তথা ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত চরিত্রের কারণেই অনিবার্যভাবে সম্পদ ও আয়ের এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে এবং বেড়ে চলেছে। বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তা প্রশমনের চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা তারা বন্ধ করতে পারছে না। এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, পুঁজিবাদী কাঠামো বজায় রেখে এই সংকটের নিরসন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে উৎপাদনের সামাজিক চরিত্র ও ব্যক্তিগত ভোগদখলের তথা পুঁজিবাদের মৌলিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিবেশের গুরুতর অবনতি ঘটানোর আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকা প্রক্রিয়ায়। এই দ্বন্দ্ব পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মারাত্মক ভারসাম্যহীনতার বিপদ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে সাম্রাজ্যবাদ ও বিকাশমান দেশগুলির জনগণের দ্বন্দ্বে নতুন উপাদানের উদ্ভব ঘটেছে।
আমেরিকায় সৃষ্ট এই আর্থিক সংকট, আর্থিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইউরোপসহ নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশের জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সুপারিশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গণবিরোধী ‘বেইল আউট’ কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সারা ইউরোপে মন্দার লক্ষণ এখনও কাটেনি। সেখানেও বিশেষভাবে শ্রমিকশ্রেণি এসব গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিপ্লবী প্রতিরোধ-সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। মজুরি হ্রাস, ছাত্র-বেতন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও শ্রমিকশ্রেণি, ছাত্রসমাজ ও জনগণ রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে। এইভাবে ইউরোপীয় উন্নত দেশগুলিতেও ব্যাপক গণ-অসন্তোষের লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে গণভোটের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ঘটনা বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।
ইউরোপে বর্তমানে এক অভূতপূর্ব অভিবাসন-সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর মূলে রয়েছে একদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও অন্যদিকে পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক অঞ্চলে সামরিক হস্তক্ষেপের সন্ত্রাসী কৌশল। এসব নোংরা সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে সেসব জায়গায় জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে এবং সেখান থেকে জনগণ জীবন বাঁচাতে প্রাণ হাতে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সামাজিক ও মানবিক ট্র্র্যাজেডি।
মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর স্বীয় আধিপত্য বিস্তার, চীনের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করা, রাশিয়াকে আরো কোণঠাসা করা, ইউরোপের বাল্টিক দেশগুলিতে ‘ন্যাটো’র শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করা, এশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক সমুদ্র-অঞ্চলে স্বীয় আধিপত্য বিস্তার, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে ভাবাদর্শগত যুদ্ধকে আক্রমণাত্মক করে তোলা-এসবই হচ্ছে বর্তমান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম ভূ-রাজনৈতিক রণকৌশল। এই সামরিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রণকৌশলের জন্য সারা বিশ্বে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের ‘রেজিম চেঞ্জ’ এবং ‘প্রি-এম্পটিভ এ্যাটাকের’ নতুন আগ্রাসী তত্ত্ব অনুসরণ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে বিরোধ উসকে দিচ্ছে এবং বিভিন্ন সশস্ত্র জঙ্গিবাহিনীর জন্ম দিচ্ছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পরিবর্তে এখন তথাকথিত ‘আইএস বাহিনীকে’ (Islamic State of Syria) তার প্রধান শক্র হিসেবে আখ্যায়িত করে গোটা বিশ্বে যুদ্ধ-সন্ত্রাসের পরিবেশ বজায় রাখতে চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তার স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারসমূহসহ অন্যান্য দেশগুলোকে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে’ শামিল হতে বাধ্য করছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র অজুহাতে সে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে অপেক্ষাকৃত ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের পতন ঘটানোর অভিযান চালাচ্ছে। এটিও সত্য যে, কুখ্যাত ঘাতকশক্তি ‘আইএস’-এর উদ্ভবের পেছনে রয়েছে আমেরিকারই নোংরা হাত। আফগানিস্তানে তালেবান ও আল-কায়েদার ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ‘আরব বসন্তকে’ কেন্দ্র করে সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যে যে গণতান্ত্রিক জাগরণ ঘটেছিল, তার অনেকখানিই বর্তমানে তারা ছিনতাই করে নিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে ভিত্তি করে মার্কিনিরা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মানচিত্র রচনার দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রেও
লিপ্ত রয়েছে। সিরিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করা এবং সে দেশের সরকারকে উৎখাত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে মার্কিনিরা সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু করেছিল, রাশিয়ার ভূমিকার কারণে তা তাদের পক্ষে এখন আর সফল করা সম্ভব হচ্ছে না।
লাতিন আমেরিকার বামপন্থী ধারার জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকারগুলি ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রাকৃতিক সম্পদ জাতীয়করণ এবং সেখান থেকে লব্ধ আয় দিয়ে সামাজিক খাতে জনগণের জন্য ব্যয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এজন্য তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিকল্প আর্থিক জোট যেমন-সেলাক (CELAC), আলবা (ALBA), আনসুর (ANSUR) ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। কিউবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কাজে লাগানোর চেষ্টাও তারা করেছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং অভ্যন্তরীণ কায়েমি স্বার্থের আক্রমণের মুখে পড়েছে। ফলে অনেকক্ষেত্রেই এদের গণতান্ত্রিক-প্রগতিমুখীন বিকাশ স্থায়ী হতে পারছে না। লাতিন আমেরিকায় যে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবী শক্তিগুলি ক্ষমতায় এসেছিল, সেগুলির ক্ষেত্রেও এখন সাধারণভাবে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। তেলের দামের ক্রমাগত অধোগতির দরুন এবং পুঁজিবাদী বিশ্বে সূচিত মন্দা এখনও না কেটে যাওয়ার ফলে, এসব দেশের জনপ্রিয় শাসকরাও অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে এবং পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থা সৃষ্টিতে ইন্ধন দিয়ে প্রগতিশীল সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ক্রমাগত অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
নানারূপ রাজনৈতিক-সামরিক-অর্থনৈতিক অপকৌশল গ্রহণ করা সত্ত্বেও, ইউরোপ ও আমেরিকায় বৈশ্বিক পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সংকট নিরসন কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বেশিরভাগ দেশে গড় বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে। বেশিরভাগ দেশেরই ঋণের বোঝা বিপুল এবং তা বর্তমানে জিডিপি’র প্রায় ৬০ শতাংশ। আমেরিকা হচ্ছে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঋণগ্রস্ত দেশ। বর্তমানে আমেরিকার বেশিরভাগ ‘ট্রেজারি বন্ডের’ মালিক হচ্ছে শ্রমঘন রপ্তানিকারক উন্নয়নশীল দেশসমূহ। চীন একাই ২০১৫ সাল নাগাদ আমেরিকাকে যে ঋণ দিয়েছে, তা আমেরিকার রাষ্ট্রীয় ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান।
ঋণ-সংকটে জর্জরিত হয়ে আমেরিকার বিভিন্ন উৎপাদন প্রতিষ্ঠান একটার পর একটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমতাবস্থায় অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামনে প্রধান উপায় হয়ে থাকছে তার সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের অস্ত্র-শস্ত্র এবং পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের মালপত্র বাজারজাত করা। এজন্য সারা দুনিয়ায় উত্তেজনা ও যুদ্ধের উসকানি প্রদানে এবং স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের সন্ধানে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ হন্যে হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছে। বর্তমানে অবশ্য অস্ত্র-বাজারেও আমেরিকার একচেটিয়া আধিপত্য আগের মতো আর নেই। সেখানে ভারি অস্ত্রের বাজারের ক্ষেত্রে রাশিয়ার এবং হালকা অস্ত্রের বাজারের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান বেশ শক্ত। অন্যান্য কিছু কারণসহ সেজন্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম রণকৌশল হচ্ছে ইউরোপে রুশবিরোধী এবং এশিয়ায় চীনবিরোধী অক্ষ জোট গড়ে তোলা।
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে নানাধরনের সংস্কার অব্যাহত আছে। এসব সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য হলো উৎপাদন শক্তির বিকাশের জন্য উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংস্কার সাধন। এজন্য শাসন-ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বল্প পরিমাণে ছাড় দেওয়া, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনার বদলে বাজার-সম্পর্কের বিস্তার, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রসার ইত্যাদি সংস্কারের পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এসবের ফলে চীন ও ভিয়েতনামে উৎপাদন-শক্তির চোখে পড়ার মতো ত্বরান্বিত বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে, এর ফলে সেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্যও অনিবার্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া বৈশ্বিক মন্দার কারণে চীনের সফল রপ্তানি-বাজারও বর্তমানে ক্রমসংকোচনের শিকার হচ্ছে। কিউবাও সতর্কতার সঙ্গে সংস্কারের পদক্ষেপ এগিয়ে নিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করায়, কিউবাকে একঘরে করে রাখার দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কোরিয়া উপদ্বীপে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা আক্রমণাত্মক ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। চীন শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সমাধানের নীতি নিয়ে চলছে। আমেরিকা চীনকে আরো বিচ্ছিন্ন করার জন্য চীন-ভিয়েতনাম, চীন-ভারত, চীন-রাশিয়া, চীন-পাকিস্তান, চীন-বাংলাদেশ ইত্যাদি সম্পর্কের মধ্যে বিরোধ উসকে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
এসব বিভেদ সৃষ্টির কৌশলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক চীনের উদীয়মান ও ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা খর্ব করা এবং ‘চীন-ঠেকাও’ পরিকল্পনা কার্যকর করা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ‘আসিয়ান’ (Asian) জোটকে এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। সামগ্রিক বিচারে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য বজায় রেখেই আঁকাবাঁকা পথে কম-বেশি সামনে এগিয়ে চলেছে।
উপর্যুক্ত আন্তর্জাতিক প্রবণতাগুলি বিবেচনায় নিলে অনিবার্যভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, পুাঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের সংকট নিরসন হওয়ার বদলে বহুক্ষেত্রেই সংকট প্রসারিত হয়েছে। সেসব দেশের অভ্যন্তরেই শ্রমিকশ্রেণি, ছাত্রসমাজ ও মধ্যস্তরের জনগণের অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে, সারাবিশ্বে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, শান্তিকামী মানুষের সংগ্রাম ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। প্রতিক্রিয়ার দুর্গ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তা নতুন আশার আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর পুঁজিবাদ সম্পর্কে যেভাবে বলা হয়েছিল ‘TINA’ অর্থাৎ ‘There is no alternative’, তা এখন বদলে গেছে। সারাবিশ্বে এখন নতুন স্লোগান উঠেছে ‘TIA’ অর্থাৎ ‘There is an alternative’।
আঞ্চলিক পরিস্থিতি
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনায় পাকিস্তানে তালেবানদের ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। ফলে পাকিস্তানের কোনো কোনো অঞ্চলে ‘বিশেষত ফাটা এবং উত্তর ওয়াজিরিস্তানে’ সন্ত্রাসী মৌলবাদীদের সমান্তরাল প্রশাসন-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে এসব তালেবানি শক্তি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সেখানে পাকিস্তানের সামরিকবাহিনী তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। ফলে পাকিস্তানে গড়ে উঠেছে সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদীদের ঘাঁটি। আর, সে ঘাঁটি থেকে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রে অস্ত্র-অর্থ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রপ্তানি অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারের অভ্যন্তরীণ বিষয়টিকে পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিকীকরণের উদ্যোগ নেয় এবং এক্ষেত্রে সকল রীতি-নীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলায়।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন অব্যাহত আছে। একথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, ভারতে এখন কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজির শাসন চলছে। এদিকে বাংলাদেশে চলছে লুটেরা ধনিকশ্রেণির রাজত্ব। বিবেচনায় রাখতে হবে যে, দুদেশের জনগণের পারস্পরিক স্বার্থে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুদেশের জনগণের সাধারণ স্বার্থে প্রকৃত ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা’র জন্য যা করা বা না করা উচিত, তার সঙ্গে দুদেশের শাসকশ্রেণির সংকীর্ণ স্বার্থ প্রসারিত করা সবসময় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশে ভারতের পুঁজি-রপ্তানি বেড়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি বেড়েছে তাদের মুনাফা এবং তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ। সীমান্তে বিরোধ, সীমান্তে হত্যা, চোরাচালান, তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে সমস্যা, টিপাইমুখ বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, বাংলাদেশি রপ্তানির বিরুদ্ধে শুল্ক-বহির্ভূত অন্যান্য প্রশাসনিক বাধা, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি, রামপাল-সুন্দরবনে তথাকথিত ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানির মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতিসাধান ইত্যাদি সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। দুইদেশের মধ্যে অপরাধীদের আনাগোনা অব্যাহত রয়েছে। দুদেশের অপরাধীরা বর্তমানে নিজেদের মধ্যে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে তা ভাঙার চেষ্টা শুরু হয়েছে। অবশ্য এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসারও ঘটেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ছিটমহল সমস্যার সমাধান। ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ ও আর্থিক সাহায্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া ‘ট্র্যানজিট’ চুক্তি, সীমান্ত-হাট চালু ও সেসব সূত্রে যাতায়াত ও ব্যবসারও প্রসার ঘটছে। তবে এসব করা হচ্ছে অনেকটা একতরফাভাবে এবং বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল শর্তে। ট্র্যানজিট চুক্তি বহুপাক্ষিকভাবে ব্যবহৃত না হলে, এতে ভারতের প্রচুর সুবিধা হবে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের লাভ খুব একটা হবে না।
আফগানিস্তানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিরসন হলেও, সেখানে এখনও তালেবান শক্তির অবস্থান অব্যাহত রয়েছে।
আল-কায়েদা এখনও সেখানে তৎপর। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব উগ্র জঙ্গিবাদী শক্তি দমনে ব্যর্থ হয়ে এবং নিজ দেশের
অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে আফগানিস্তান থেকে তার অধিকাংশ সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। আফগানিস্তানের অবস্থা এখন পর্যন্ত অস্থিতিশীল ও বিপজ্জনকই রয়ে গেছে।
শ্রীলংকায় দীর্ঘকাল ধরে চলে-আসা গৃহযুদ্ধের অবসান হয়েছে। তবে অন্যান্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত সামনে এসেছে। শ্রীলংকায় ভারতের প্রভাব বেড়েছে। দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির চমক দেখাতে পারা সত্ত্বেও, রাষ্ট্রপতি রাজাপাক্সে গত নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে। সংবিধান নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়েছে এবং নতুন সংবিধান প্রণীত হয়েছে। সেখানে নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও অনেকগুলো কমিউনিস্ট দলের সমন্বয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নেপালের ওপর ভারতের অন্যায় চাপের ফলে এই দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এই চাপ সত্ত্বেও নেপাল তার নতুন সংবিধান কার্যকর করতে সক্ষম হচ্ছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেষ্টা আছে এ অঞ্চলে ভারতকে কেন্দ্র করে চীনবিরোধী জোট গঠন করা। ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক আরো নিবিড় করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে চীনের সঙ্গে ভারত এবং আমেরিকা উভয়ের বিস্তৃত অর্থনৈতিক লেনদেনও রয়েছে। সম্প্রতি এনএসজি সংস্থায় অন্তর্ভুক্তিসহ কয়েকটি ইস্যু নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমেরিকার সঙ্গে নৈকট্য বেড়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চীন, ভারত, আমেরিকা ইত্যাদি সকলের সঙ্গে কম-বেশি সুসম্পর্ক বজায় রেখে অগ্রসর হওয়ার কথা বলা হলেও, ভারত-মার্কিন অক্ষের সঙ্গে সে নিজেকে নানাভাবে কার্যত আবদ্ধ করে ফেলেছে। বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিসহ সামরিক, নিরাপত্তা, গোয়েন্দা কার্যকলাপ ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এসবের বেশিরভাগই করা হয়েছে গোপনে। যুক্তরাষ্ট্র কুখ্যাত ‘সোফা’ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র-বন্দর নির্মাণ, পদ্মাসেতু নির্মাণ ইত্যাদি বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার একপাক্ষিকভাবে ভারত বা বিশ্বব্যাংক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে না ঝুঁকে চলার চেষ্টা করলেও, তাদের চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত বহুলাংশে পরোক্ষভাবে নতি স্বীকার করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোটে শরিক হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরাইল ও তার গোয়েন্দা-সংস্থা ‘মোসাদে’র তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমাদের উপমহাদেশে সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িকতা এবং সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। পাকিস্তান এখনও জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদিকে ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপি’র প্রকৃত পরিচালনা অনেকটাই উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএসসহ সংঘ পরিবার প্রমুখ বিপজ্জনক শক্তির হাতে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সরকার পরাজিত হওয়ার পর, এখনও তারা সেখানে তাদের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ভোট গতবারের চেয়ে তেমন না কমলেও, আসন-সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ত্রিপুরায় অব্যাহতভাবে ক্ষমতাসীন থাকতে সক্ষম হলেও এবং কেরালায় এবার জয়লাভ করতে পারলেও, গোটা ভারতে সামগ্রিকভাবে বামপন্থীদের শক্তি হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া, কংগ্রেসের শক্তি ধসে পড়ার সুযোগ নিয়ে, বিজেপি’র নেতৃত্বে ভারতের সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রক্রিয়া বিপজ্জনকভাবে প্রসারিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ দুরভিসন্ধিমূলকভাবে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি ও সাম্প্রদায়িক প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে এবং তাকে মদত দিচ্ছে। নিজেই সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদকে মদত দিয়ে, সেই জঙ্গিবাদ দমন করার কাজে সহায়তা করার কথা বলে, উপমহাদেশের দেশগুলোর ওপর সাম্রাজ্যবাদ তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়িয়ে চলছে। ফলে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ হলো পরস্পরের পরিপূরক এবং সে কারণে এই দুই বিপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একই সূত্রে গাঁথা।
এই কালপর্বে চীনের উদ্যোগে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে BRICS (Brazil, Russia, India, China, South Africa) ব্যাংক। প্রধানত চীন ও ভারতের উদ্যোগে এশিয়ায় নতুন ‘অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক’ (Asian Infrastructure Investment Bank) তৈরি হয়েছে। সেখানে যুক্ত থাকার জন্য এখন এমনকি পশ্চিমা দেশগুলি ও বিশ্বব্যাংকও উন্মুখ হয়ে এগিয়ে এসেছে। এশিয়ান হাইওয়ে এবং রেলওয়ের মাধ্যমে চীন-মায়ানমার-ভারত-বাংলাদেশ পরস্পর সংযুক্ত হতে চলেছে।
এ ধরনের বহুপাক্ষিক আঞ্চলিক সহযোগিতার মূলে যে দর্শন কাজ করছে, তা হচ্ছে ‘এশিয়ার জন্য এশিয়া’ (Asia For Asia) বা ‘প্রাচ্যের দিকে তাকাও’ (Look at the East) নীতি। এই উদ্যোগ সফল হলে চীন
ও ভারতকে কেন্দ্র করে এশিয়ায় বা প্রাচ্যে নতুন এক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। একবিংশ শতকে প্রাচ্য তথা এশিয়ায় বিশ্বঅর্থনীতির কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা ও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটতে পারে, সেজন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মরিয়া হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার অনেক দেশই সেই ষড়যন্ত্রের মুখে নত হয়ে পড়ছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী মোতায়েন থাকা তাদের নৌ-শক্তির ৬০ শতাংশকে তারা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে স্থানান্তরিত করবে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি মিত্র দেশগুলির সমুদ্র ব্যবহার করে আমেরিকান নৌ-বাহিনী নানা রকম সামরিক মহড়া, ঘাঁটি স্থাপন ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে ঠেকানো। এদিকে চীনের পক্ষেও এসব সামুদ্রিক পথে শান্তি ও কর্তৃত্ব বজায় রাখাটা খুবই জরুরি। কারণ এসব পথেই চীনের আমদানি-রপ্তানি, জ্বালানি সামগ্রী আদান-প্রদান করা হয়ে থাকে। ক্রমবর্ধমান চীন-মার্কিন এই দ্বন্দ্বের পটভূমিতে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠতা ভারতের সঙ্গেই বেশি এবং ভারতকে মাধ্যম করেই তারা সমগ্র উপমহাদেশে তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের কৌশল গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে ভারত ও বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও অন্যান্য নানা ধরনের তৎপরতা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতকে তার পরিপূর্ণ আজ্ঞাবহ করার জন্য ‘হাত মুচড়ে’ তার ওপর চাপ তৈরির উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে তার বর্ধিত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আছে।
উপমহাদেশের আরেকটি বিপজ্জনক ইস্যু হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ ইস্যু। আশা করা হয়েছিল যে, অং-সাং-সুচির দল মায়ানমারে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বার্মিজ রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন কমবে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হয়নি। ফলে বাংলাদেশে তাদের অবৈধ আগমন অব্যাহত রয়েছে এবং তাদেরকে ভিত্তি করে বাংলাদেশে মুসলিম সাম্প্রদায়িক জঙ্গি শক্তিগুলি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে যে, আঞ্চলিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কর্তব্য হলো, মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-জঙ্গি শক্তিগুলির আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ভেঙে দিয়ে, সাম্রাজ্যবাদের আঞ্চলিক রণকৌশলকে ভেস্তে দিয়ে, সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাধীন স্বনির্ভর উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। এজন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর শাসকশক্তি ও সরকারগুলোর ওপর ভরসা করে থাকলে হবে না। এজন্য যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো, উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে এবং তাদের নিজ নিজ দেশে শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন-সংগ্রামগুলির ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা ও সংহতি আরো জোরদার করা।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছিল। সেই সময় নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ‘দিন বদলের সনদের’ ঘোষণা দিয়েছিল। সে ঘোষণা সরকার বাস্তবায়ন করেনি। ২০১৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়া বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেও সেসব ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়নি। পুরনো সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ধারাতেই সে এখনও দেশ পরিচালনা করে চলছে। তদুপরী এই সময়কালে নির্বাচন-ব্যবস্থাকেও আমূল ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। অর্থনীতি ও সমাজের যেটুকু অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়, তা লুটেরা শাসকদের কোনো কৃতিত্বের নিদর্শন নয়। বরং তা মূলত কৃষকসমাজ, শ্রমিকসমাজ, বিশেষ করে পোশাকশিল্পের নারীশ্রমিক, প্রবাসীশ্রমিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাবৃন্দ ইত্যাদি উৎপাদনশীল শ্রেণিসমূহের পরিশ্রম ও বেঁচে থাকার সৃজনশীল সংগ্রামেরই ফসল। দেশ বস্তুত এক ধরনের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটজালে আবদ্ধ হয়ে আছে।
এই সময়কালে আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ এবং সর্বশেষে ৭ শতাংশের কাছাকাছি উপনীত হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির প্রকৃত চেহারা শুধু প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না। এসময় মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ শতাংশের নিচে অবস্থান করেছে। প্রধানত রেমিটেন্সের কল্যাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৮ মাসের চেয়ে বেশি আমদানি ক্ষমতার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোষাগারে জমা রয়েছে।
দাবি করা হয় যে, ‘প্রবৃদ্ধি’ ও ‘স্থিতিশীলতা’র নিরিখে এ সময় আমাদের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করেছে। বলা হয়, এর লক্ষণ দেখা যায় দারিদ্র্য-হার হ্রাস পাওয়ার মধ্যে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, দেশের দারিদ্র্য-হারের পরিমাপ নির্ভর করে দারিদ্র্যের সংজ্ঞায়নের ওপরে। দারিদ্র্যের বিষয়টি শুধু একটি অর্থনৈতিক বিষয়ই নয়, তার রয়েছে ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত একটি সামাজিক মাত্রিকতাও। একথা ঠিক যে, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার, স্যানিটেশন, জেন্ডার প্যারিটি, প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তৃতি, গড় আয়ু ইত্যাদি সামাজিক সূচকের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু শুধু পরিসংখ্যান ও সূচক দিয়ে পরিস্থিতির প্রকৃত ও পূর্ণ চিত্র প্রতিফলিত হয় না।
অগ্রগতি সম্পর্কে প্রচারিত এসব চিত্র ম্লান হয়ে যায় যখন সমাজে ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদ বৈষম্য, বেকারত্ব-কর্মহীনতা, কমিশন প্রাপ্তির লোভে প্রকল্প নির্ভরতা, নানা ধরনের লুণ্ঠন-দুর্নীতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদের উত্থান, নৈতিকতার অবক্ষয়, সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি, শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতি, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, চিকিৎসাক্ষেত্রে গরিবের অসহায়ত্ব, কৃষকের ফসলের লাভজনক দামের অভাব, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বনিম্নতম অবস্থান, উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিবর্তে বিদেশে বিপুল অর্থের পাচার ইত্যাদি নেতিবাচক ঘটনাগুলি বিবেচনায় নেওয়া হয়। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে বুঝতে মোটেও কষ্ট হয় না যে, বর্তমান তথাকথিত ‘উন্নয়ন ধারার’ আসল অবস্থাটি কতটা ফাঁপা। দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে শুধু পুুকুর চুরি হয়নি, ‘সাগর’ চুরি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল অর্থ। গত ১০ বছরে পাচার হয়েছে সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা, যা আমাদের বার্ষিক জাতীয় বাজেটের চেয়েও প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি এবং জিডিপি’র এক-চতুর্থাংশ। ২০১২ সাল পর্যন্ত সরকার ৩৪,০০০ কোটি টাকা খেলাপিঋণের অবলোপন করেছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে এই অবলুপ্ত খেলাপিঋণের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরো ৩,৭০০ কোটি টাকা। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ, শেয়ার-মার্কেট, ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে চুরি ও লুটপাটের পরিমাণ ছিল আরো প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা। এসব অপরাধী লুটপাটকারীরা চিহ্নিত হয়েছে ঠিকই, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়নি। ফলে ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে। সমাজে শোষণ-বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল-মডেল বলে দাবি করা হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনে তার ছোঁয়া এসে পড়ছে না। তারা এখনও সমস্যা-সংকটে জর্জরিত হয়ে আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সংসদ সদস্যপদ থেকে শুরু করে অন্যান্য সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় পদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে। বেকারত্ব ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সরকারি হিসাবেই প্রতিবছর ২০ লাখ যুবক শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে এবং তাদের মধ্যে কেবল ৩০ শতাংশ দেশ-বিদেশে কাজ খুঁজে পাচ্ছে। অন্যরা থাকছে বেকার হয়ে। পরিকল্পনাহীনতার কারণে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। মানসম্পন্ন চাকরি না থাকায় যুবশক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
কৃষি ও তার সঙ্গে জড়িত কৃষক ও ক্ষেতমজুররা আমাদের সমাজের অগ্রগতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কৃষি আজ চিরাচরিত কায়দায় চলছে না। বর্গাপ্রথার প্রায় অবসান হয়ে জন-জমা প্রথার প্রচলন ঘটেছে। কৃষি এখন অনেকটাই বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে দরিদ্র ও মাঝারি কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। কিছু ধনী কৃষক তাদের অবস্থা উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। শহরের এক শ্রেণির কিছু ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কৃষিজমি কিনে গ্রামে বিনিয়োগ করছে। কোন ফসলে লাভ আসবে-তা চিন্তা করে অনেক কৃষক চাষবাস বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর ফলে কৃষকের ভাগ্য বাজারের ওঠানামার ওপর চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে এর ফলশ্রুতিতে গ্রামে ফসলের বহুমুখীকরণ হচ্ছে। মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু, ফলমূল, সবজির মতো খাতগুলো দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। লোকসানের ভয় থাকা সত্ত্বেও এসব খাতের বিকাশ ঘটিয়ে কৃষক ও ক্ষেতমজুরেরা টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কৃষিখাতে সরকারের বরাদ্দ গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত আপেক্ষিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে হাইব্রিড বীজের বাজারে অনুপ্রবেশ, আমাদের ঐতিহ্যবাহী বীজ ও বিভিন্ন ধরনের ফসলের শুধু বিলুপ্তিই ঘটাচ্ছে না, কৃষি ও কৃষককে বহুজাতিক কোম্পানির অবাধ শোষণের কাছে জিম্মি করে ফেলছে। সরকার ব্যক্তিখাতে
প্রণোদনার কথা বললেও, দেশের সর্ববৃহৎ ব্যক্তিখাত কৃষি থাকছে উপেক্ষিত। প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ, গবেষণা, আধুনিক প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত থাকছে কৃষি ও কৃষক। সরকার কৃষিতে ভর্তুকি ও ঋণ অব্যাহত রাখলেও, তা যৎসামান্য। মানসম্পন্ন সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ, সেচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিতে সংকট অব্যাহত রয়েছে। এই সময়কালে কৃষক ধানসহ তার উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পায়নি। এমনকি উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে তা বিক্রি করতে সে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা ফসলের চূড়ান্ত দামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ততোধিক অংশ নিজেদের পকেটে নিয়ে গেছে। বর্তমানে গ্রামের মানুষকে কৃষির পাশাপাশি অকৃষির দিকেও ঝুঁকতে হচ্ছে। গ্রামে ভূমিহীনদের অনুপাতও বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ভরা মৌসুমের কোনো কোনো সময় কৃষি-মজুরি বৃদ্ধি পেলেও, সারাবছর ক্ষেতমজুরের কাজের নিশ্চয়তা নেই। কাজের জন্য গ্রামীণ মজুরদের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাঁরা এখন আরো বেশি করে অকৃষি কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কৃষি-জমি ও জলাভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত না করায় অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ শিল্পায়নের নামে কৃষিজমি ধ্বংস করা হচ্ছে। কৃষক-পরিবারের সন্তানরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে গিয়ে কষ্টকর জীবন-যাপন করে, শহরাঞ্চলে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কাজে অংশ নিয়ে উপার্জিত অর্থের একাংশ গ্রামে পাঠাচ্ছে। তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা সচলতা দেখা যাচ্ছে। আমূল ভূমি সংস্কার ও কৃষি সংস্কার এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ও গ্রাম জীবনের বিপ্লবী পুনর্গঠন ব্যতীত যে কৃষির গৌরবোজ্জ্বল ধারাকে অগ্রসর করা ও তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করা যাবে না-সেকথা বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির আরেকটি অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে শিল্পখাত এবং তাতে নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষরা। আর এই শিল্পখাতের নেতৃত্ব দিচ্ছে পোশাকশিল্প। শুধু উন্নত ইউরোপ-আমেরিকায় নয়, মধ্য-উন্নত দেশগুলিতেও (ভারত, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ইত্যাদি) আমাদের পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাওয়ার যে বিশাল সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানো যাবে কিনা সেটি অনেকখানি নির্ভর করছে এই খাতে বর্তমানে যে ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মরত তাদের ন্যায্য মজুরিপ্রাপ্তি, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ভোগ, দক্ষতা বৃদ্ধি, শ্রমিক-কল্যাণের সুবিধাপ্রাপ্তি ইত্যাদি এবং সেইসঙ্গে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, নতুন নতুন প্রযুক্তিতে আরো বিনিয়োগ, উন্নত ব্র্যান্ডের প্রবর্তন, বিনিয়োগকারীকে বন্দর, বিদ্যুৎ, জমি, গ্যাস, পানি ইত্যাদির নিশ্চয়তা প্রদান ইত্যাদির ওপর। একইসঙ্গে এগুলি পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝামেলামুক্ত সুশাসন কায়েম, বিদেশি মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ-সক্ষমতা অর্জন এবং সরকারের পক্ষ থেকে বাজার অনুসন্ধান, ব্যাপকভাবে উপজেলায় উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদির ব্যবস্থা করার ওপর। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। বরং যে বিপুল আয় এই শিল্পে হচ্ছে, তার বেশিরভাগ অংশই মালিকেরা ভোগে নিঃশেষ করছে এবং অংশত বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এদিকে, এ সময়কালে গড়ে প্রতিবছর শ্রমিকের মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে তাদের মজুরি বাড়েনি। দেখা যায় যে, এসময় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে শ্রমিকরা নিজেদের খাটুনি দিয়ে বাড়তি চার টাকা যোগ করে থাকলে, তা থেকে নিজেরা পেয়েছিল মাত্র বাড়তি এক টাকা আর মালিকরা নিয়ে নিয়েছে তিন টাকা। বাংলাদেশের শিল্পখাতে শ্রমিকদের ওপর আপেক্ষিক শোষণের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বস্তুত এক অর্থে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বরং হ্রাস পেয়েছে। পোশাক শিল্পখাতের শ্রমিকদের যে অবস্থা, তা সমগ্র শিল্পখাতেরই সাধারণ চিত্র। তাদের জন্য জাতীয় ন্যূনতম মজুরিও নির্ধারণ করা হয়নি। এদেশের শ্রমিকরা শুধু ন্যায্য মজুরি থেকেই বঞ্চিত থাকছে না, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও তাদের নেই। উপযুক্ত কর্মপরিবেশ, কর্মস্থলের নিরাপত্তা ইত্যাদি ন্যূনতম বিষয়গুলোর নিশ্চয়তাও তাদের ক্ষেত্রে নেই। এ দেশের শ্রমিকশ্রেণি আজ নিদারুণ শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়ে আছে।
দেশে বড় আকারে এনজিও তৎপরতা চলছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদের চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী নীতির ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্য, বৈষম্য, বেকারত্বের কারণে যে সামাজিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদের ‘নিরাপত্তা-জাল’ হিসেবে এনজিওরা কাজ করছে। বর্তমানে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রদত্ত সাহায্য সরকারের মাধ্যমে প্রদানের পরিবর্তে বেশি করে এনজিওর মাধ্যমে
প্রদানের প্রবণতা রয়েছে। এনজিওগুলো নানা সংস্কারমূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এনজিওখাত একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কর্পোরেট পুঁজিতে পরিণত হয়ে কোনো কোনো এনজিও এখন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে। সেসব এনজিও বিরাজনীতিকীকরণের নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এনজিওতে সাধারণভাবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, রাষ্ট্রীয় তদারকি নেই; আছে গণতন্ত্রহীনতা, অনিয়ম, লুটপাট ও দুর্নীতি। বর্তমানে এক নতুন এনজিও-এলিট শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। দারিদ্র্যবিমোচনের নাম করে গ্রামীণ জনপদে ক্ষুদ্রঋণের প্রসার ঘটানো হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের মাত্রাতিরিক্ত সুদের কারণে এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিও-র ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার বদলে গ্রামের মানুষ ঋণের জালে আটকা পড়ে যাচ্ছে। ফলে সারাদেশে ঋণ-জর্জরিত দরিদ্র দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে যেসব এনজিও এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসায় নিয়োজিত তাদের অনেকের শান-শওকত ক্রমাগতই বাড়ছে। এনজিওর সংস্কারমূলক কিছু কার্যক্রমের ফলে তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। এধরনের ‘সংস্কারের’ বিরোধিতা করার কারণ না থাকলেও, সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা কর্তব্য। এনজিও সম্পর্কে একথা মনে রাখতে হবে। সব মিলিয়ে বলা যায় যে, সামগ্রিক বিবেচনায় এনজিও একটি নেতিবাচক ও বিপজ্জনক উপাদান।
শিক্ষায় পাশের হারের অগ্রগতি নিয়ে ঢাকঢোল পেটালেও, শিক্ষার গুণ ও মানের অগ্রগতি ঘটেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে ভোগবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রবণতা বিস্তৃত হচ্ছে। দেশে এখনও এক ধারার শিক্ষা চালু হয়নি। দরিদ্রদের জন্য এক ধরনের শিক্ষা এবং ধনীদের জন্য আরেক ধরনের শিক্ষা চালু রয়েছে। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চলছে মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, এ-লেভেল ও-লেভেল শিক্ষা ইত্যাদি। ইউনেসকো’র সুপারিশ হলো শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ বরাদ্দ করা। সরকার সে সুপারিশ অনুসরণের বদলে ৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেটুকুও সে দিচ্ছে না। ২০১৬-১৭ সালের জন্য বাজেটে শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তিখাতকে যোগ করে এ বাবদ মোট বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে বলে দেখানো হলেও, তার পরিমাণ জিডিপি’র মাত্র ২.৫ শতাংশ। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা ও বেতন নিশ্চিত হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যদিও ২ কোটি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা শুরু করে, কিন্তু এইচএসসি অতিক্রম করতে করতে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৫ লক্ষে নেমে আসে। অর্থাৎ ৮ ভাগের ৭ ভাগ শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ে। পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে বিপুল পরিমাণ শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে কওমী মাদ্রাসা ও ক্যাডেট মাদ্রাসা এই দুই ধরনের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানেরই প্রস ার লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদ্রাসাসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে বিজাতীয় ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী ভাবধারা প্রাধান্য পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকছে উপেক্ষিত। শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। শিশু-শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ এখন অন্যতম উপসর্গ। এর ওপর রয়েছে বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া ‘ইউজিসি কৌশলপত্র’। যার প্রধান লক্ষ্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। বাণিজ্যিক কারণে গজিয়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও বাণিজ্যিকভাবে কোর্স চালু করা হচ্ছে। চিকিৎসা-শিক্ষাকেও বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। কোচিং বাণিজ্য অব্যাহত আছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের প্রভাব, শিক্ষকদের বেতনসহ অন্যান্য সমস্যা দূর না করায় শিক্ষায় নৈরাজ্য বেড়ে চলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বরাদ্দ, বরাদ্দকৃত টাকা দুর্নীতি মুক্তভাবে খরচ এবং সর্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক, গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তার আলোকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া দেশকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে অগ্রসর করা যাবে না।
দেশের সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে চরম অবক্ষয়ের ধারা বিস্তার লাভ করে চলেছে। সবকিছুই বাণিজ্যিকীকরণ, পণ্যায়ন, ভোগবাদ, প্রদর্শনবাদ ইত্যাদির গ্রাসে বিকৃতি লাভ করছে! সুস্থ স্বাভাবিক সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে দেশ অপসংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। নৈতিকতার বিপজ্জনক স্খলন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষেত্রে আমাদের দেশের চিকিৎসার মান বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও চিকিৎসার মান ও পেশাদারিত্ব আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের উন্নত চিকিৎসা
ব্যবস্থাপনা ও উচ্চ প্রযুক্তি তো দূরের কথা, প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতিও আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নাগালের বাইরে। সাধারণভাবে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারি দুই ভাগে বিভক্ত। এর একটি বড় অংশই রয়েছে সরকারি খাতে, যার মূল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ঔপনিবেশিক কাঠামোর এক চরম দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র। পরিকল্পনাহীনতা, দলীয়করণ, অপ্রতুল অর্থায়ন, প্রশাসনিক নৈরাজ্য ও দুর্নীতির অপ্রতিহত ব্যাপ্তি গোটা সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থাকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চিকিৎসা পাওয়ার দ্বিতীয় উৎস বেসরকারি খাতে চিকিৎসার অবাধ বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। চিকিৎসা পণ্যে পরিণত হওয়ায়, কেউ নীতি-নৈতিকতার ধার ধারছে না। ওষুধপত্রের দাম ও ডায়গনেস্টিক সেন্টারের খরচ নাগালের বাইরে হু হু করে বেড়েই চলেছে। ওষুধের ‘জেনেরিক’ নামে বাজারজাত না করায় দেশি-বিদেশি ওষুধ কোম্পানি একচেটিয়া বারবার চালিয়ে লাগামহীনভাবে ওষুধের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ভেজাল ওষুধের কারবার বাড়ছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার বহন করা সম্ভব নয়। এজন্য রাষ্ট্রের নিজস্ব পরিচালনায় সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য একটি দক্ষ, গতিশীল, সুসমন্বিত, সহজলভ্য, সুষম ও অভিন্ন গণমুখী চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, প্রতিরোধমূলক সামাজিক স্বাস্থ্য-পরিকল্পনা গ্রহণ, চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের পেশাগত উৎকর্ষ ও নৈতিক মান বৃদ্ধি, গণমুখী ওষুধনীতি প্রণয়ন-বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-সংকটের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একটা সার্বিক স্বাস্থ্য-আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
প্রচলিত পুঁজিবাদী উন্নয়ন-দর্শন হলো প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী। পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন, ব্যক্তিগত মুনাফা বৃদ্ধি, লুণ্ঠন, দখলদারিত্ব ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ গুরুতর বিপদের সম্মুখীন। এসব ইস্যুতে বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। নদী রক্ষা, সুন্দরবন রক্ষা, বনাঞ্চল রক্ষা, পার্ক রক্ষা, কৃষিতে ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা, জমির উৎপাদনশীলতা রক্ষা, বন্যা-দুর্যোগ-ভূমিকম্প, শব্দ দূষণ থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। নদী-খাল-বিল দখল ও বেআইনিভাবে ভরাট করা হচ্ছে। বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড় কাটা, নদীতে নির্বিচারে বাঁধ-ব্রিজ নির্মাণ, জমিতে কীটনাশক ও অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ন, যেখানে সেখানে অপরিকল্পিত ইটভাটা স্থাপন, আগ্রাসী পদ্ধতিতে পানি শোষণ ইত্যাদি বিপজ্জনক সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সুন্দরবন ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। আগ্রাসী আবাসন ব্যবসায়ীরা পরিবেশের নিয়ম-কানুন মানছে না। প্রাকৃতিক জীবন এখন বাঁধা পড়েছে রাসায়নিক জীবনে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরো বাড়ছে। এভাবে পরিবেশকে বিপন্ন করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ভূমি-ব্যবহার নীতি না থাকার ফলে, আবাদি জমি কমে যাচ্ছে ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর বিপদাশঙ্কার পাশাপাশি ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা এবং টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প, চীনের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর বাঁধ ইত্যাদিও বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য হুমকি রূপে বিরাজ করছে। পরিবেশ রক্ষায় সরকার কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম, অত্যাচার ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। তাঁদের জীবন, জমি-জমা, সম্পত্তি আজ পরিকল্পিত ধারাবাহিক হামলার সম্মুখীন। একদিকে অর্থনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল ও তার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি তাঁদের ওপর যেভাবে ক্রমাগত ঘৃণ্য হামলা চালাচ্ছে, তা এসব মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও অসহায় করে তুলেছে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনসহ অনেক কালাকানুনের কুফল এখনও তাঁদের ওপর চেপে বসে আছে। হামলা চালিয়ে তাঁদের সম্পত্তি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের দেশত্যাগের হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন তরিকার অনুসারী মুসলমানদের ওপরও আক্রমণ নেমে আসছে।
আদিবাসী ও দলিতদের ক্ষেত্রে একধরনের নিবিড় পশ্চাৎপদতা ও সুযোগহীনতা অব্যাহত রয়েছে। আদিবাসীদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলছে। আদিবাসীদের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ভূমির ওপর তাঁদের অধিকারের স্বীকৃতি, তাঁদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ইত্যাদি আজও নিশ্চিত করা হয়নি। দলিত ও আদিবাসীদের জন্য প্রয়োজন গড় সামাজিক সুরক্ষার চেয়ে বাড়তি সামাজিক সুরক্ষা। সেই আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের নীতি ও অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়েছে। দুর্বল জনগোষ্ঠী হওয়ায় তাঁদের ওপর
চলছে বাড়তি শোষণ ও অত্যাচার-নিপীড়ন। ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’র পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়া, জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অধিকার এখনও অর্জিত না হওয়া ইত্যাদি কারণে পরিস্থিতি তাঁদের জন্য সবসময় নাজুক হয়ে থাকছে।
নারীসমাজের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় ইতিবাচক পরিবর্তন ও অগ্রযাত্রার ধারা লক্ষ্য করা যায়। তবুও নারীসমাজ অব্যাহতভাবে পুঁজিবাদ ও পুরুষতান্ত্রিকতার দ্বারা আক্রান্ত। সাম্প্রদায়িকতারও তাঁরা প্রথম ও প্রধান শিকার। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। শহরে, মফস্বলে ও এমনকি পাড়াগাঁয়ের নারীরা শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে।
নারী-পুরুষের মধ্যে কাজ ও মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করছে। গণমাধ্যমে নারীকে চিরাচরিত গৎবাঁধা অমর্যাদাকরভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নারীকে পণ্যে পরিণত করে রাখা হয়েছে। ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অবমাননাসহ নানামাত্রিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের পদচারণা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তা সত্ত্বেও নারী এখনও ভোগের সামগ্রী হিসেবে এবং বিনা মজুরিতে শ্রমদাতা হিসেবে বহুলাংশে বিবেচিত হয়ে থাকে। নারীর গার্হস্থ কাজের এখনও সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই। নারীরা ঘরে-বাইরে বৈষম্য, নিপীড়ন, নিগ্রহ, অত্যাচারের শিকার। নারী-শিশু ধর্ষণ, যৌন-নির্যাতন, অপহরণ, বিদেশে পাচার ইত্যাদি শুধু অব্যাহতই নয়, সেগুলো ক্রমাগত বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং সরকারের অবস্থান অনেকক্ষেত্রেই নারীপ্রগতির বিরুদ্ধে। মৌলবাদীদের বিরোধিতার মুখে সরকারের আপসকামী অবস্থানের কারণে পূর্ণাঙ্গভাবে নারী-নীতি চালু হয়নি। নারীকে শৃঙ্খলিত করে রাখা, সম্পত্তির সমঅধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে রাখা এবং ‘ইউনিফর্ম-ফ্যামিলি কোড’ প্রচলনের বিরোধিতা ইত্যাদি অব্যাহত রয়েছে। নারী আন্দোলনের এনজিওকরণ চলছে। বিপ্লবী ধারার নারী আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এনজিওরা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিতৃতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈষম্য-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীমুক্তির সংগ্রামকে আরো জোরদার করার গুরুত্ব বেড়েছে।
বাংলাদেশে শিশুদের অবস্থা দিন দিন নাজুক হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে উৎকট বৈষম্য বিরাজ করছে। একদিকে বৃহৎ অংশ গড়ে উঠছে চরম অবহেলায় নিজের মতো করে। ধনী পরিবারের শিশুদের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও, বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ছে না। তারা গড়ে উঠছে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে। শিশু-ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। শিশু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। অপসংস্কৃতির গ্রাসে হতাশাগ্রস্ত তরুণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যাতায়াত ও যোগাযোগ-ব্যবস্থায় চলছে চরম সংকট। পরিবহন-ব্যবস্থায় এক নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছে। সড়ক-দুর্ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত ও বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গণপরিবহন-ব্যবস্থার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তাকে ধ্বংস করা হয়েছে। বেসরকারি পরিবহনের কাছে মানুষ এখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে জিম্মি। নৌ-যাতায়াত ব্যবস্থা অবহেলিত। রেল-ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। রেল পরিচালনায় দক্ষতার অভাব, ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য, উন্নয়ন ও পরিকল্পনায় দূরদৃষ্টি ও সমন্বয় নেই। পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট, যানজট, বাড়ি-গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, হত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি ইত্যাদি ক্রমবর্ধমান। আমাদের সীমিত তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। রপ্তানিমুখী পিএসসি’র মাধ্যমে সমুদ্রের গ্যাস ব্লকগুলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।
সমাজে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-সংবিধানে এই এরশাদি বিধান বহাল রাখার ফলে সাম্প্রদায়িকতা মদত পেয়েছে। জামায়াতসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি পরিকল্পিতভাবে সমাজে স্কুল-কলেজ-ব্যাংক-ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সেবা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এখানে কোটি কোটি টাকা প্রতিবছর পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের অনুসারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা বিধান এবং একই সঙ্গে ওই ভাবাদর্শের বর্ধিত পুনরুৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। দমন-পীড়ন চালিয়ে এই বিপদের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এজন্য একদিকে জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি, তথা তাদের ভাত-কাপড়ের অধিকারের জন্য সংগ্রাম শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন এবং অন্যদিকে মৌলিক আর্থ-সামাজিক বিপ্লবের পরিপূরক গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শভিত্তিক সুদূরপ্রসারী এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ
কাজই নিদারুণভাবে অবহেলিত ও দুর্বল হয়ে আছে। এসব কাজে প্রগতিশীলদেরই সাহসের সঙ্গে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা খুবই প্রয়োজন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে উপযুক্তভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম জোরদার করা এখন সময়ের জরুরি দাবি।
সমাজে নীতি-নৈতিকতার-অবক্ষয়, ঘুষ-দুর্নীতি, অপরাধ-প্রবণতা ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, মাদক ইত্যাদি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বাড়ছে। সাইবার পর্নগ্রাফি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসনের একাংশ ও মাদক-ব্যবসায়ীদের নিয়ে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জুয়ার কারবারও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের যুগে পণ্যপূজার মূল্যবোধ সমাজের পরতে পরতে অনুপ্রবেশ করেছে। এই মূল্যবোধ মানুষের মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করেছে। সমাজের ভোগবাদের সঙ্গে অদৃষ্টবাদের প্রাবল্য যুগপৎ বেড়েছে। পুঁজিবাদের ভোগবাদী মুনাফাকেন্দ্রিক অধঃপতিত নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক-মানবিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংগ্রাম জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি
দেশের রাজনীতির হালচাল এখন বেশ গুরুতর। জাতীয় রাজনীতির সামগ্রিক ধারা ক্রমাগতভাবে আরো ডানপন্থী চেহারা ধারণ করছে। রাষ্ট্রের চরিত্রের দক্ষিণমুখীন অধোগতি ঘটছে। ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, দেশে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে’-এ ধরনের বার্তা প্রচার করা হলেও এবং বাহ্যিকভাবে অনেকটা সে রকম মনে হলেও, প্রকৃতভাবে প্রায় সব ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে অস্থিতিশীলতা, নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তার উপাদানগুলো। দেশবাসীর মনে এক ধরনের থমথমে ভাব বিরাজ করছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের মনে বিরাজ করছে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে, প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রিত রাখার মাধ্যমে সরকার পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা রাখতে সক্ষম হলেও, প্রকৃত অবস্থা মোটেও তা নয়। ভেতরে ভেতরে জমছে ক্ষোভ। রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী হস্তক্ষেপ-নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির বিপদ বেড়েই চলেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় দেশে এখন বিরাজ করছে বিপজ্জনক ও রুগ্ণ এক পরিস্থিতি।
দেশের এরূপ হাল হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে যে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে, পরিস্থিতির বর্তমান রুগ্ণতা তারই স্বাভাবিক ফলাফল। আমাদের মতো দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ উপনিবেশ-উত্তর দেশে বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা প্রায় সবক্ষেত্রেই যে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর, ফটকাবাজি-লুটেরা চরিত্র ধারণ করে, বাংলাদেশের গত ৪০ বছরের ঘটনাবলি তারই প্রমাণ বহন করে। চার দশকের বেশি সময় ধরে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ও তার নয়া উদারবাদী আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণের ফলেই রুগ্ণতার ভয়াবহ প্রকোপ ও অব্যাহত সংকটজালে দেশ নিমজ্জিত হয়ে থাকছে। যে পথে দেশ চলছে, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতমুখী এবং বৈরী চরিত্রের। এ থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো, দেশকে রুগ্ণতা ও সংকটমুক্ত করতে হলে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা-ধারা, তথা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির পথে দেশকে ফিরিয়ে আনা আজ অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। তাই, বিরাজমান এরূপ পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি যে রণকৌশলই গ্রহণ করুক না কেন, তাতে তার ‘সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের’ মৌলিক রণনৈতিক কর্তব্যটি সবসময়ই প্রত্যক্ষভাবে সন্নিবেশিত রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে থাকছে।
রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একথাটি গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের মহান মক্তিযুদ্ধ ছিল জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী মাইলফলক। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীলতা ছিন্ন করে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার’ রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতির ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরু থেকেই সে ক্ষেত্রে ছিল স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল দেশি-বিদেশি শক্তিসমূহের অন্তর্ঘাত, ষড়যন্ত্র, বৈরিতা। সঙ্গে সঙ্গে ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, ঘাটতি, দুর্নীতি ও অন্যায় কার্যকলাপ। ’৭৫ সালে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারার পথ থেকে সম্পূর্ণ বিপথগামী করা হয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে দেশে চলছে সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিকশ্রেণির শাসন। এ কালপর্বের মধ্যে দেড় দশক ধরে প্রত্যক্ষভাবে অথবা বেসামরিক লেবাসে দেশে চলেছে সেনাশাসন।
’৯০-এ সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর নির্বাচিত বেসামরিক সরকার ও সাংবিধানিক শাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তারপরে ২৬ বছর পার হয়েছে। এর মাঝে ২ বছরের সেনা-সমর্থিত ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ সময়কাল বাদ দিলে, প্রায় আড়াই দশক ধরে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দুটি বড় বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে পালাক্রমে ৪ বার হাত বদল হয়েছে। গত ২০১৪ সালে একটি প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একাদিক্রমে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য আওয়ামী লীগ নিজেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করাতে সক্ষম হয়েছে। বিএনপি সেই নির্বাচন বয়কট করেছিল। স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সংসদীয় বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এদিকে, সংসদের বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা মন্ত্রিসভাতেও আছে। ফলে তাকে মানুষ বিরোধী দল মনে করে না। সাধারণ মানুষের কাছে এখনও প্রধান বিরোধী দল হলো বিএনপি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজ নিজ ক্ষমতার সমীকরণ মেলানোর প্রয়োজনে অন্যান্য দলকে নিয়ে কৌশলগত ঐক্য, গোপন সমঝোতা, জোট-মহাজোট গঠন ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে দেশের রাজনীতিকে কার্যত তাদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র দুটি বলয়ে এখনও বেঁধে রেখেছে। দেশি-বিদেশি শাসক-শোষক শ্রেণির পরিকল্পনা এবং তাদের বিপুল অর্থশক্তি, প্রচার-মাধ্যমের ওপর তাদের আধিপত্য ইত্যাদির সহায়তায় এবং অন্য নানা পথে ও কৌশলে তথাকথিত মূলধারার রাজনীতি কার্যত এই দ্বি-দলীয় মেরুকরণভিত্তিক বৃত্তে এখনও শক্তভাবে বাঁধা পড়ে আছে। রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এই দুটি পরষ্পর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকেই রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে এখনও প্রাসঙ্গিক করে রাখা হয়েছে। এর বাইরে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ধারায় চলা রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পরিকল্পিতভাবে প্রান্তস্থিত করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও, তারা একই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অনুসারী। তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারগুলো সাম্রাজ্যবাদনির্ভর মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন অনুসরণ করায় এ দেশে বিনিয়োগমুখী ধনতন্ত্রের বদলে লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছে। আমাদের দেশে এটিই হলো অবাধ পুঁজিবাদের পথ অনুসরণের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এর ফলে রাজনীতিতে বেড়েছে বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্বৃত্তায়ন ও আদর্শহীনতার প্রবণতা। কলুষিত হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বস্তুত, এই দুটি বুর্জোয়া দলের নেতৃত্বে এসব আত্মঘাতী প্রবণতা এমন মাত্রা ও রূপ পরিগ্রহ করেছে যে, দেখে মনে হয়, সেইসব অপশক্তির হাতে তারা নিজেরাও আজ কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে। জনগণের সম্পদ লুটপাট ও লুটের ভাণ্ডার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে পরস্পরবিরোধী এই দুটি দল ও জোটের মধ্যে তো বটেই, এমনকি নিজ নিজ দল ও জোটের অভ্যন্তরেও হানাহানি, সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকছে। এসবের ফলে দেশ আজ এক স্থায়ী নৈরাজ্যের মধ্যে পতিত হয়েছে। এ কারণে দেশের রাজনৈতিক-সাংবিধানিক প্রক্রিয়াও সব সময়ই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এ ধরনের নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তা চরমে উঠলে, তা শাসকশ্রেণির জন্য অস্বস্তিকর ও অসহনীয় হয়ে ওঠে। বুর্জোয়া রাজনীতির সংকট ও দেউলিয়াপনার ফলে সৃষ্ট এরূপ চরম দ্বন্দ্ব, সংঘাত, হানাহানি, নৈরাজ্য ও অনিশ্চয়তার মুখে ২০০৭ সালে তারা, বিশেষ করে বিদেশি শক্তিসমূহ, ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ ঘটনা সংগঠিত করেছিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এখনও সে ধরনের আশঙ্কা দূর হয়েছে বলে ভাবা ঠিক হবে না। তবে সাধারণভাবে তারা এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্যের’ পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী ও তৎপর। কারণ ‘নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্য’ বহাল রেখে, দুপক্ষের দ্বন্দ্ব-হানাহানি-সংঘাতের সুযোগে, এসব বিদেশি শক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়। সেই সুযোগে তারা উভয় বুর্জোয়া দলের নিকট থেকে নানা ধরনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি কনসেশন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।
‘ওয়ান-ইলেভেনে’র দুবছরের শাসনের পর, সেই সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেসময়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ৫ বছরের দুঃশাসন এবং ‘ওয়ান–ইলেভেন’ সরকারের দুবছরের যন্ত্রণা, নির্যাতন ও নানা সন্দেহজনক কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে অধিকাংশ মানুষ ‘পরিবর্তনের’ জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন মহাজোট দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ভোটারদের বড় অংশের মধ্যে তাদের সপক্ষে সমর্থন গড়ে উঠেছিল। সংসদে আওয়ামী লীগ এককভাবে তিন-চতুর্থাংশ আসন ও মহাজোটগতভাবে চার-পঞ্চমাংশ আসনে জয়লাভ করেছিল। এতে জনগণের মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল।
বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে সংসদের
সাংবিধানিক শক্তির প্রায় একচেটিয়া ভিত্তি, জনগণের সমর্থন ও ইতিবাচক প্রত্যাশা ইত্যাদি অনুকূল পরিস্থিতিতে নতুন এই সরকারের সামনে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল ধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগ সরকার কাজে লাগায়নি। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার আন্তরিক কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণের বদলে বরং আর্থ-সামাজিক নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা ধনবাদের ধারাতেই দেশ পরিচালনার পথ সেই সরকার গ্রহণ করেছিল। ফলে দেশের সংকটের উৎস দূর করার ক্ষেত্রে কোনো মোড় পরিবর্তন ঘটেনি। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান দ্বিতীয় মেয়াদকালেও এক্ষেত্রে কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মোড় পরিবর্তনের বদলে আওয়ামী লীগই উল্টো তার দলের নীতিগত অবস্থান উল্টিয়ে ফেলেছে। সে এখন মূলত পঁচাত্তর-উত্তর প্রতিক্রিয়াশীল ভ্রান্ত ট্র্যাক ধরে চলছে।
বস্তুত আওয়ামী লীগ ’৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিলেও বর্তমানের আওয়ামী লীগ এখন আগের মতো নেই। এই দলের শ্রেণিচরিত্র আমূল বদলে গেছে। একসময় এই দলের নেতৃত্বে যেখানে প্রাধান্য ছিল মধ্যস্তর ও উঠতি ধনিকদের (উকিল, শিক্ষক, কর্মচারী, ডাক্তার, ছোট ব্যবসায়ী ইত্যাদি), সেখানে এখন প্রাধান্য লাভ করেছে লুটেরা ধনিকশ্রেণি ও বড় বুর্জোয়ার প্রভাব। যে দলের নেতৃত্ব থাকে এ রকম শ্রেণির হাতে, সেই দল বা সেই দলের সরকার দ্বারা যথাযথভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
সিপিবি দেশবাসীকে আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল যে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। নির্বাচনে গণরায়ের মুখোমুখি হওয়ার বদলে বিএনপি দেশে একটি অরাজক ‘পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করে, দেশের সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে ‘শর্ট-সার্কিট’ করে, আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল। জামায়াতকে তারা এক্ষেত্রে তাদের নীল নকশার সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করেছিল। জামায়াতের সব সময়েরই মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানি এজেন্ডার বাস্তবায়ন। তাছাড়াও তার সামনে আশু জরুরি এজেন্ডা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনালে দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া পণ্ড করে দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে আনা। এ উদ্দেশ্যে সেসময় জামায়াত এখন তাদের সন্ত্রাসী, অন্তর্ঘাতমূলক নাশকতা বাড়িয়েছিল। জামায়াতের এসব কর্মকাণ্ডকে মদত দিয়ে বিএনপি তাদের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া
শর্ট-সার্কিট করার পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে, একতরফা নির্বাচন করে বিজয় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিএনপিকে নির্বাচন বয়কট করতে বাধ্য করাতে এবং তার জায়গায় জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল সাজিয়ে মাঠে নামানোর রাজনৈতিক কূটচালের অংশ হিসেবে সরকার ‘সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর’ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এভাবে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়টিকে অনিশ্চিত করে তোলা হয়েছিল। সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সম্ভাবনা কার্যত বিনষ্ট করা হয়েছিল। আমরা বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার এবং আওয়ামী লীগকে জামায়াত নিষিদ্ধ করার যে আহ্বান জানিয়েছিলাম, তাতে দুটি দলের কোনোটিই সাড়া দেয়নি। আমাদের সেসব সতর্কবাণী যে সঠিক ছিল, ঘটনাবলি তা প্রমাণ করেছে।
এ ধরনের পটভূমিতে দেশব্যাপী প্রবল সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতির মধ্যে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের একটি বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ, একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রার্থীরা ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী বলে ঘোষিত হয়। এভাবে, ভোট শুরুর আগেই, অধিকাংশ ভোটারের কোনো ধরনের অভিমত প্রকাশের সুযোগ কার্যত বন্ধ করে দিয়ে এক অভিনব কায়দায় মহাজোট দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য সরকার গঠনের সক্ষমতা ‘অর্জন’ করে নেয়। অবশিষ্ট ১৪৬টি আসনে ভোটের নামে চালানো হয় নির্লজ্জ প্রহসন। এই কলঙ্কিত নির্বাচনী প্রহসন দ্বারা বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের খেলা এবং সেসময়ের জন্য তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ বন্ধ করা সম্ভব হলেও, তাতে করে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, গণতন্ত্র ইত্যাদি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। জাতিকে সেই ক্ষত আজও বহন করতে হচ্ছে। তা আরো গভীর ও বিস্তৃত হচ্ছে। একথা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দমন করার জন্য জামায়াত ও তদ্রুপ সন্ত্রাসী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিষিদ্ধ এবং সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। গণতন্ত্রে এসব শক্তির স্থান নেই। বরং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন না করাটাই গণতন্ত্রের জন্য বিপদ ডেকে
আনে। জামায়াতসহ জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিষিদ্ধ এবং তাদের আর্থিক, সাংগঠনিক, আদর্শিক ভিত্তি ও কাঠামো নির্মূল করার এই জরুরি ও অত্যাবশ্যক কাজটি যথার্থভাবে না করে, পক্ষান্তরে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে খর্ব ও ধ্বংস করা এসব অপশক্তিকেই বরং সুযোগ করে দেয়। দেখা যাচ্ছে যে, সরকার সে রকমই করছে। ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি দুর্বল না হয়ে বরং আরো প্রসারিত হচ্ছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ট্রাইব্যুনালে ২৪ জনের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিচার ও দণ্ড প্রদানের বিষয়ে সরকারের দৃঢ়তা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সূচিত হয়। অতি দ্রুত তা অভাবনীয় শক্তি নিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। জনমতের এরূপ বিস্ময়কর জাগরণের মুখে সরকারকে বাদিপক্ষের আপিল করার সুযোগ প্রদানসহ আইনের কিছু পরিবর্তন করতে হয়। আপিলে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ মৃত্যুদণ্ডে পরিণত করা সম্ভব হয়। বিএনপি ও জামায়াত গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অপপ্রচারে নামে। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তারা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে। তারা সহিংস সংঘাত সৃষ্টিরও চেষ্টা করে। এদিকে হেফাজাত-ই-ইসলামকে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে মাঠে নামানো হয়। এই শক্তি ঢাকাসহ দেশব্যাপী তাণ্ডব সৃষ্টি করে। সিপিবি’র কেন্দ্রীয় অফিসে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। তখন থেকে একেরপর এক ব্লগার, মুক্তমনা ব্যক্তি, ভিন্ন চিন্তার ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা শুরু হয়। এমনকি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যাঁরা এদের ব্যাখ্যার বাইরে চিন্তা করে, তাঁদের ওপরেও হামলা শুরু হয়ে যায়। এসব বীভৎস সন্ত্রাসী আক্রমণ ক্রমাগতভাবে ও আতঙ্কজনক মাত্রায় বাড়ছে। সমাজে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও এরূপ অনেক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, এমনকি তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা শুরু হয়েছে। আইএস, জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলাদেশ প্রভৃতি সংগঠন এসব হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করছে। বাংলাদেশকে জঙ্গি কবলিত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে এ দেশকে সাম্রাজ্যবাদের ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে ফেলার জন্য বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের পরিকল্পনাও এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে কাজ করছে বলে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে।
সূচনায় গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যে শক্তি নিয়ে জেগে উঠেছিল, তা কয়েক মাসের মধ্যে স্তিমিত হতে থাকে। জামায়াত, হেফাজত, বিএনপি ইত্যাদি শক্তি সরাসারি গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে। অন্যদিকে, কয়েকদিন যেতে না যেতেই যুবশক্তির সেই মহাজাগরণের প্রতি সরকারও বৈরী আচরণ গ্রহণ করতে শুরু করে এবং তার বিস্তার ও স্থায়িত্ব রোধ করতে তৎপর হয়। গণজাগরণ মঞ্চকে বিভক্ত করারও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের আবেদন নিঃশেষ করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে শুধু নয়, নবপ্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্জাগরিত করার ক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চের অবদানকে ঐতিহাসিক বলা চলে।
নানা মহলের বাধা সত্ত্বেও সরকার শেষ পর্যন্ত কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে জামায়াতের ওপর বড় ধরনের আঘাত এসেছে। তবে তাদের প্রকাশ্য সাংগঠনিক কাঠামো ও তৎপরতা ভেঙে পড়েছে বলে বাহ্যিকভাবে প্রতীয়মান হলেও, তারা কাজের পদ্ধতি ও কর্মকৌশল বদল করে সুকৌশলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি’র সঙ্গে তারা জোটবদ্ধ হয়ে আছে। আবার, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের আদর্শবর্জিত, ক্ষমতাকেন্দ্রিক আত্মঘাতী নীতির সুযোগে এবং আওয়ামী লীগ কর্তৃক স্বাগত হয়ে তারা অনেকে দল বেঁধে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। আওয়ামী ওলামা লীগের ব্যানার থেকে এবং অনেক দায়িত্বশীল আওয়ামী নেতার মুখ থেকে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য, প্রচারণা ও কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে। নানাভাবে দেশের সামনে সাম্প্রদায়িক বিপদ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
দেশের জন্য জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট-জঙ্গি অপশক্তিগুলোই হলো বর্তমানে বিশেষভাবে বিপজ্জনক শক্তি। ক্ষমতাসীনদের সুবিধাবাদী চরিত্র, দুর্বলতা-ব্যর্থতার সুযোগে তারা এখন বাস্তব বিপদে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের একেবারে গোড়াতেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জামায়াতকে মূল টার্গেট হিসেবে গণ্য করে আঘাত করেনি। তখনই এ ক্ষেত্রে বড় একটি রাজনৈতিক সুযোগ নষ্ট করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে, বিএনপি’র কাঁধে ভর করে থাকা জামায়াত তার শক্তিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তারা
এখন একই সঙ্গে গোপন ও প্রকাশ্য তৎপরতা চালাতে সক্ষম। মাঝেমধ্যে পেশীশক্তি প্রদর্শন করার ক্ষমতাও তাদের আছে। অন্তর্ঘাত, কমান্ডো কায়দায় হামলা ইত্যাদি কাজেও তারা সক্ষমতা অর্জন করেছে। জামায়াত ছাড়াও আরো অনেকগুলো সশস্ত্র সন্ত্রাসীবাহিনী তৎপর রয়েছে। এদের কারো কারো আন্তর্জাতিক কানেকশন রয়েছে। তৃণমূলে সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারা সম্পর্কে অস্পষ্টতা, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল আদর্শগত রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে ক্ষমাহীন অবহেলা, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক পথে জনগণের ভাত-কাপড়, রুটি-রুজির সমস্যা সমাধানের ও বৈষম্য-দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের আশা জাগাতে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির ব্যর্থতা ইত্যাদির সুযোগ নিয়ে জামায়াতসহ জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি বর্তমানে দেশে এক বিপজ্জনক অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে।
২০১৪ ও ২০১৫ সালে আন্দোলনের নামে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারাসহ বিএনপি-জামায়াতের বিভীষিকাময় সন্ত্রাসী কাজকর্মে জনগণের মধ্যে গুরুতর বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়। সরকার তাদের ওপর তীব্র দমন-নীতি প্রয়োগ করে। জামায়াতের সংগঠিত সাংগঠনিক কাঠামো তা সামলে উঠে ভিন্ন কায়দায় টিকে থাকতে পারলেও, এর ফলে বিএনপি’র সাংগঠনিক কাঠামো ও তৎপরতা অনেকটাই তছনছ হয়ে পড়ে। প্রধানত বিএনপি’র জামায়াত-সখ্যের নীতি, হঠকারিতা, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি অনুসরণ ইত্যাদি তাদের বর্তমান এমন বেহাল অবস্থার জন্য দায়ী। এর সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার মামলা-হামলা, দমন-পীড়ন চালিয়ে বিএনপিকে অকার্যকর শক্তিতে পরিণত করতে তৎপর রয়েছে। বিএনপিকে বিভক্ত করতেও তারা সচেষ্ট আছে। এসবের মুখে বিএনপি নিজের শক্তি এখনও গুছিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে না। নিজেকে আবার প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য বিএনপি’র ভারত নীতিতে কিছু সুর বদল, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শিথিল করা ইত্যাদি পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে বিএনপিতে এখনও একটি শক্তিমান উগ্র ক্ষমতা-কেন্দ্র বিদেশে বসে কলকাঠি নাড়ছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি’র সাংগঠনিক শক্তিকে কোণঠাসা করতে সক্ষম হওয়ায়, বিএনপি’র নিচের দিকের কিছু নেতা-কর্মী-ক্যাডার চাপে পড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানও করছে। কিন্তু বিএনপি’র জনসমর্থনকে নিজের পক্ষে টেনে আনতে সে সক্ষম হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কমছে।
বিএনপি’র দক্ষিণপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, লুটপাটতন্ত্রের স্বার্থরক্ষায় বিএনপি যে আওয়ামী লীগের চেয়ে আরো দক্ষ ও পারদর্শী, তা প্রমাণের মাধ্যমে সে দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণির মদত পাওয়ার চেষ্টা করছে। জনগণ আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করলেও, বিএনপি’র দ্বারা মৌলিকভাবে ভিন্ন কোনো সুশাসনের ধারা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলে জনগণ মনে করে না। এ কারণে বিএনপি’র পেছনে জনগণ উৎসাহ নিয়ে সমবেত হচ্ছে না। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ‘হাওয়া ভবনের’ দুরাচার, বাংলা ভাই ও জেএমবি’র প্রতি সমর্থন, অস্ত্র আটকের ঘটনা, গ্রেনেড হামলা, সিরিজ বোমা হামলা, ভূয়া ভোটার তালিকা, খাম্বা কেলেঙ্কারি, তেল-গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশে পাচার ইত্যাদি বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের সময়কার স্মৃতি এখনও মানুষ ভোলে নাই। মানুষ আওয়ামী লীগের শাসন পছন্দ করছে না। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ফিরে আসুক, সেটাও তাঁরা মন থেকে চায় না। এই দুই শক্তির বাইরে একটি বিকল্প সৎ-প্রগতিশীল রাজনৈতিক সরকার তারা চায়। কিন্তু তাদের সামনে সে ধরনের শক্তি এখনও তাঁরা প্রত্যক্ষ করতে পারছে না। বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো কার্যকর শক্তি দৃশ্যমান হিসেবে দেখতে না পাওয়ায় জনগণের একটি বড় অংশ বিএনপি’র দিকে ঝুঁকে থেকে এখনও তার নীরব সমর্থক হয়ে আছে।
সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকতর কেন্দ্রীভবনের ধারা বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো শক্তভাবে গ্রাস করেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র সার্বিক নিয়ন্ত্রণ এখন আরো বেশি করে ও একচ্ছত্রভাবে দলীয় ‘সুপ্রিমোর’ হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে। নেত্রীর বিরাগভাজন হওয়ার পরিণতি হলো দলীয় অবস্থান ও ভূমিকা পালন থেকে বাদ পড়ে যাওয়া। ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ সরকারের আমলে উভয় দলের কিছু নেতা-কর্মী ‘সংস্কারপন্থী’ আখ্যা নিয়ে নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চালুর জন্য প্রকাশ্যে কথা বলতে ও তৎপরতা চালাতে শুরু করেছিল। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে সেসব নেতাকে প্রথম দফায় সরকার ও দলীয় নেতৃত্ব থেকে কার্যত বাদ দেওয়া হয়েছিল। এবার তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী দায়িত্বসহ দলের কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএনপি’র অবস্থাও ততটা না হলেও অল্প বিস্তর একই রকম। দলীয়করণ এখন সর্বত্র
আরো প্রসারিত শক্ত আসন গেড়ে বসেছে। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে যাঁরা দলীয় প্রভাবমুক্ত থেকে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করেছে, সেই বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যেও এই দলীয়করণ ছড়িয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর নাগরিকবৃন্দের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত ক্রমাগত কমে আসছে। সরকারের প্রশাসনিক কাজ-কর্মের ওপর সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উপর তলার নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়ছে। সবক্ষেত্রে বাড়ছে দলীয় হস্তক্ষেপ। সরকারের নীতি নির্ধারণ ও কাজ-কর্ম পরিচালনায়
সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রভাব বেড়েই চলেছে। সেখানে দেদারসে চলছে ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য ইত্যাদি। কিন্তু প্রায় সবক্ষেত্রে ও স্তরে কাজের দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক যন্ত্রগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠলেও, তার জনকল্যাণমূলক কাজ দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের ভূমিকা ও অবদানকে কমিয়ে আনার নয়া-উদারবাদী বুর্জোয়া নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের পরিধি ও মান ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে জনকল্যাণ ও জনসেবা কার্যক্রমের বেসরকারিকরণ ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। এই প্রবণতা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাতে লুটেরা ধনিকদের প্রভাব ও দাপট বৃদ্ধি করার পথ তৈরি করে দিচ্ছে।
নীতি-আদর্শ বর্জিত ক্ষমতার রাজনীতিতে লিপ্ত দুটি বুর্জোয়া দলের নোংরা খেলার বলি হয়ে চলেছে দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সামরিক শাসন ও সামরিক স্বৈরাচারের যুগে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার পর অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে নির্বাচনের ন্যূনতম মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। কিন্তু বুকের রক্ত দিয়ে আদায় করা সে অধিকার আবার হরণ করে নির্বাচনকে এক নোংরা তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। টাকা, পেশিশক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক ধুম্রজাল ইত্যাদি থেকে নির্বাচনকে মুক্ত করার জন্য অর্থপূর্ণ কোনো প্রয়াস কোনো সরকার কখনই গ্রহণ করেনি। কিন্তু অবস্থার এখন আরো অবনতি হয়েছে। ‘টাকার খেলার’ বেশিরভাগটাই ঘটে যাচ্ছে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের শুরুতে মনোনয়ন-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। এর পরে, নানা কায়দায় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মনোনয়ন জমা দেওয়া থেকে বিরত রেখে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ খালি মাঠে জিতে আসা, ভোটের আগের রাতে ভূয়া ব্যালট দিয়ে ভোট-বাক্স ভরে রাখা, নির্বাচনের দিন সন্ত্রাস চালিয়ে ভোট-কেন্দ্র দখলে নিয়ে নেওয়া, সুযোগ মতো ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ছাপ্পা ভোট দেওয়া, ফলাফলের কাগজ কাটাকাটি করা ইত্যাদি পদ্ধতিগুলো এখন সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এসব বিকৃতি বেড়েই চলেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তার পরে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এসব প্রবণতা ধাপে ধাপে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় ১৪৫ জন নিহত হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থার ওপর মানুষের ন্যূনতম আস্থা আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। দেশের রাজনীতির জন্য এ এক গুরুতর বিপজ্জনক অশনি সংকেত।
দেশের বিচার-বিভাগ এখনও পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন হয়ে উঠতে পারেনি। বিচার-ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা বজায় থাকছে না। বিচার-বিভাগ ও আইন-বিভাগের (সংসদের) মধ্যে কে বেশি সার্বভৌম ও কার ওপরে কে কর্তৃত্ব করবে-এ ধরনের বিতর্ক মধ্যে মধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে। কখনও কখনও তাদের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান ও অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রের ও শক্তির হস্তক্ষেপ ক্রমাগত বাড়ছে। আমেরিকা, ভারত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশ রাজনীতিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে নাক গলিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান তার দীর্ঘদিনের শত্রুতা অব্যাহত রেখেছে এবং নানা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কোথাও বা কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে, দেশের দীর্ঘদিনের জোটনিরপেক্ষতার নীতিকে বিসর্জন দিয়ে, বাংলাদেশ সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে শরিক হয়েছে। বিশ্বপরিমণ্ডলের আন্ত-রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাত এ দেশের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্র ও শক্তি তাদের আজ্ঞাবহদের মাধ্যমে এ দেশে এক ধরনের ছায়া-যুদ্ধ পরিচালনা করছে। এ কারণেও দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতার উপাদান সবসময় বিদ্যমান থাকছে।
নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন ও ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও, আওয়ামী লীগ সরকার এ ক্ষেত্রে একেবারেই উল্টো পথে চলছে। ‘ওয়ান-ইলেভেনের’
সরকারের আমলে অপূর্ণাঙ্গভাবে হলেও স্থানীয় সরকারসমূহের ক্ষমতা বাড়ানোর যে আইনগত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়েছিল, সেগুলোও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। বিকেন্দ্রিকরণের বদলে ক্ষমতার অধিকতর আমলাতন্ত্রীকরণ ও কেন্দ্রিভবন ঘটে চলেছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড আরো বেশি করে রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এর সুযোগে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের উঁচু পদের কর্তাব্যক্তি, সংসদ সদস্যবৃন্দ প্রমুখ আরো বেশি করে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করে নিতে সক্ষম হচ্ছে।
সরকার এখন আর গণরায়ের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। জনগণের প্রত্যক্ষ সমর্থনের সক্রিয় প্রকাশের জন্য তোয়াক্কা না করে, ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা এখন সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনযন্ত্রের ওপর নির্ভরতা, লুটেরা ধনিকশ্রেণির মদত এবং বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রভুদের আশীর্বাদের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতা নিশ্চিত করার পথ গ্রহণ করেছে। যখন জনগণের বদলে রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে ওঠে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক, তখন তা থেকে জন্ম নিতে থাকে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। সরকার ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’-এরূপ তত্ত্ব সামনে এনে এই প্রবণতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। বর্তমানে দেশের রাজনীতিকে সেরূপ এক বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু এই পথ সরকারের জন্যও আত্মঘাতী। মনে রাখা দরকার যে, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং লুটেরা ধনিকশ্রেণি ও বিদেশি প্রভুশক্তিকে যখন ক্ষমতার নির্ধারক করে তোলা হয়, তখন এসব শক্তি যেকোনো সময় গদি বদল করার সক্ষমতাও তার দ্বারা অর্জন করে নেয়। ক্ষমতার ওলট-পালট করার সুযোগ তাদের হাতে থাকলে সেটি তারা মর্জি মাফিক ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আরেকটি উপাদান হলো এটি।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতেই জন্ম নিয়েছে তার রাজনৈতিক সংকট। পরিস্থিতির দাবি হলো, গোটা অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। এই মৌলিক বিষয়টি ক্রমেই জনগণের উপলব্ধিতে আসছে। দুটি বুর্জোয়া দলের হাতে দেশের সরকার ও রাজনীতি আজ বন্দী থাকার ফলেই যে লুটপাট, অনাচার, দুর্ভোগ ইত্যাদির বেড়াজালে দেশ ও জনগণ আরো বেশি করে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে, তা-ও জনগণ অনুভব করছে। জনগণ এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়। কিন্তু যাদের দ্বারা তাদের এই পরিত্রাণ পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হতে পারে-এমন উপযুক্ত ‘বিকল্প’ শক্তি তারা এখনই চোখের সামনে দেখতে না পেয়ে হতাশা ও নিষ্ক্রিয় নির্লিপ্ততায় চলতি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে কোনোমতে বেঁচে-বর্তে থাকার চেষ্টায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখছে।
যে বামপন্থী শক্তির দ্বারা মানুষের সামনে ‘বিকল্পে’র আশা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, তারা এখনও তাদের সেই কর্তব্য পালন করতে পারছে না। নানা পর্যায়ক্রমিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ সত্ত্বেও, বামপন্থী শক্তির মধ্যে এখনও ঐক্যের কোনো বৃহত্তর কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। তাদের অধিকাংশেরই প্রভাব ও জমায়েত-ক্ষমতা দুর্বল। তাছাড়া অনেকেরই রয়েছে নানা বিষয়ে ত্রুটি, বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি। একটি অংশ এখনও মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত থাকায়, তারা বস্তুত সরকারের অংশ হয়ে আছে। তাদের ভ্রান্তি উপলব্ধি করে এখনও তারা বিকল্প গড়ার কাজে শরিক হতে রাজি হচ্ছে না। অন্যদিকে অপর কয়েকটি বামপন্থী দল ‘গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা’য় সংগঠিত আছে। তাদের কেউ কেউ আবার বাম সংকীর্ণতা, বিপ্লবী বাক্যবাগীশতা, জনবিচ্ছিন্নতা ও বিমূর্ত তত্ত্বায়নের জগতে আবদ্ধ থাকা প্রভৃতি দুর্বলতায় আক্রান্ত। বামপন্থীদের মধ্যে সিপিবি সবচেয়ে বড় শক্তি হলেও, একক শক্তিতে ‘বিকল্পে’র দায়িত্ব পালনের মতো সামর্থ্য এখনও তাদের হয়নি। অন্যদিকে, যাদের নিয়ে ‘বিকল্প’ গড়া যেতে পারে, সেরূপ বিভিন্ন সম্ভাব্য দল ও শক্তিকে মোটামুটি একটি সঠিক ধারায় নিয়ে এসে তাদের একটি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলার কাজেও সিপিবি এখনও সফল হতে পারেনি। তবে এক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সাফল্য হলো, গত ৪ বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা সিপিবি-বাসদ-এর ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ। বাসদে ভাঙন ঘটার কারণে এক্ষেত্রে সাময়িকভাবে কিছুটা বিঘ্ন সৃষ্টি হলেও, সে ধাক্কা সামলে উঠে সিপিবি-বাসদ-এর এই ঐক্য মোটামুটি ঘনিষ্ঠ সহমতের ভিত্তিতে কার্যকরভাবে সক্রিয় থাকতে সক্ষম হচ্ছে।
সিপিবি-বাসদ-এর এই ঐক্য বৃহত্তর বাম ঐক্য এবং বাম-গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক হবে। তাছাড়া বামপন্থী শক্তির বাইরে, যাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা যেতে পারে, তেমন প্রভাবসম্পন্ন বড় কোনো দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিবাদী, সৎ রাজনৈতিক শক্তি এখনও সেভাবে দৃশ্যমান নয়। ফলে দেশবাসীর প্রত্যাশিত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির
উপস্থিতির ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এটাই এখন দেশের রাজনীতিতে একটি মূল সমস্যা ও ঘাটতি। অথচ এই অভাব পূরণ ব্যতীত সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই। এই চ্যালেঞ্জিং কর্তব্যের কথাটিকেও বিবেচনায় রেখে পার্টিকে তার রাজনৈতিক রণকৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
রাজনৈতিক কর্তব্য
সাম্প্রতিক কালপর্বের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয় যে, সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিকশ্রেণির শাসন এবং তাদের চাপিয়ে দেওয়া মুক্তবাজার নীতি, পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন, উদারীকরণ, নির্বিচার বিরাষ্ট্রীয়করণ, বিনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি আমাদের অর্থনীতিতে লুটপাট, দুর্বৃত্তায়ন, পরনির্ভরতা ও অবক্ষয়ের জন্ম দিয়ে চলেছে। উৎপাদনবিমুখ, কমিশনভোগী, পরগাছা ও লুম্পেন চরিত্রের শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। এই শাসকগোষ্ঠীর কারণে আজ দেশের ধন-সম্পদ অবাধে লুটপাট করার, অর্থনীতির স্বাধীন ও স্থিতিশীল বিকাশ রুদ্ধ করার এবং দেশবাসীর জীবন-জীবিকাকে সার্বিকভাবে বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করার এক সংকটাপন্ন আবর্ত রচনা হয়েছে।
দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী বুর্জোয়া ধারার রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার গঠন করলেও, তারা কেউ এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন করেনি এবং দেশবাসীর ভাগ্যের কোনো গুণগত মৌলিক উন্নয়নও তারা ঘটাতে সক্ষম হয়নি। অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তির শ্রেণিগত চরিত্র বদল না হলে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি-দর্শনের প্রগতিমুখীন মৌলিক পরিবর্তন না ঘটলে সংকট নিরসন হবে না। সংকটের চেহারা, রূপ ও পরিমাণের কিছু হেরফের হবে মাত্র। দেশের বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তিগুলো লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাকে’ আজ ম্লান ও ভূলুণ্ঠিত করেছে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা-ধারার মর্যাদা ফিরিয়ে এনে তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কর্তব্যটি সম্পাদন করার কাজে এখন দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদেরকেই চ্যাম্পিয়নের ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে পচন ও অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে সেই সংকট নিরসন করা যাবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বুর্জোয়া রাজনীতির দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বেড়াজাল ভেঙে বামপন্থীদের নেতৃত্বে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি এবং গণশক্তির সচেতন সংগঠিত উত্থান ছাড়া বর্তমান দুঃসহ অবস্থার মৌলিক ও স্থায়ী কোনো পরিবর্তন সম্ভব হবে না। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি সুষ্পষ্টভাবে একথাও প্রমাণ করছে যে, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী বিশ্বায়নই আজ সকল জাতির ও মানবসমাজের দুর্দশার মূল কারণ এবং একমাত্র সমাজতন্ত্রের পথ ধরেই এই সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদেরকে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধনের কঠিন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
সব সময়ের কেন্দ্রীয় কর্তব্য
বর্তমান সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধন করতে হবে। অন্য কাজ আগে সম্পন্ন করার জন্য এই মূল কর্তব্যকে স্থগিত বা পেন্ডিং রাখা যাবে না। এটিকে সব সময়ের মূল কাজ হিসেবে গণ্য করতে হবে। অপরাপর সব আশু ও জরুরি কাজের মধ্যে এই বিষয়টিকেই কেন্দ্রীয় কর্তব্য বলে বিবেচনা করে সেই মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ চারটি কাজ
এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত চারটি কাজকে গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে :
(১) লুটেরা বুর্জোয়া ধারার বর্তমান দ্বি-মেরুকরণ ভিত্তিক শক্তি-সমাবেশের বাইরে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মতো সামর্থ্য ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং জনগণের আস্থাভাজন, বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি-সমাবেশ গড়ে তোলা।
(২) দেশবাসীর সামনে জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, গণমুখী, গ্রগতিশীল ও বিপ্লবী ধারার বিকল্প কর্মসূচি উত্থাপন ও জনপ্রিয় করে তোলা।
(৩) শ্রমজীবী মানুষসহ ব্যাপক জনগণের শ্রেণিগত ও অন্যান্য ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে পরিচালিত শ্রেণিসংগ্রাম ও গণসংগ্রামের ধারায় তাদেরকে সচেতন ও সংগঠিত করে, রাজনীতি ও সমাজে বর্তমান শাসক-শোষক শ্রেণির অধিপত্য খর্ব করে, পূর্বোক্ত বিকল্প শ্রেণিশক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।
(৪) সাম্প্রদায়িকতা, সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপদ, রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা, গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করার চেষ্টা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা প্রভৃতিকে গুরুতর বিপদ বলে বিবেচনা করে তার
বিরুদ্ধে সংগ্রামে আপসহীন, দায়িত্বপূর্ণ ও অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করা।
নিজস্ব শক্তি বাড়াতে হবে
এসব মৌলিক কাজ অগ্রসর করার জন্য পার্টিকে প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। পার্টিকে শক্তিশালী করার কাজটি এ কারণে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। একথা মনে রেখে নিম্নলিখিত কাজগুলো গুরুত্ব সহকারে অগ্রসর করতে হবে:
(ক) কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি, সামর্থ্য, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, দেশের সবচেয়ে পরীক্ষিত ও দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পার্টি হিসেবে সিপিবি’র দায়িত্ব অনেক। সেজন্য পার্টিকে সত্যিকার বিপ্লব ও শ্রেণিসংগ্রামের পার্টি, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের পার্টি, জাতীয় স্বার্থরক্ষার পার্টি, গণভিত্তিসম্পন্ন পার্টি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মেহনতি শ্রেণির পাশাপাশি সমাজের সম্ভাব্য সর্বস্তরে ও সর্বমহলে পার্টির যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল সন্ত্রাসী হামলা বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস মোকাবেলায় সক্ষম, নানা জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ধারাবাহিক কাজ এগিয়ে নিতে পারদর্শী, মানুষের সুখে-দুঃখে তার পাশে থেকে লড়াকু গণসংগ্রাম ও একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে নানা ইতিবাচক গঠনমূলক কাজ এগিয়ে নিতে সামর্থ্যবান একটি সুশৃঙ্খল বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে। পার্টিকে আরো বেশি দৃঢ়তা-শক্তি-সাহস-ঝুঁকি ও সৃজনশীলতা নিয়ে সমাজের সমস্ত বিপ্লবী শক্তি ও উপাদানের উন্মেষ ঘটানোর জন্য সচেষ্ট হতে হবে। নির্বাচনী- সংগ্রামের জন্যও পার্টিকে তোলার জন্য বিশেষভাবে মনোযোগী হতে হবে এবং পার্টিকে সে কাজের জন্য অনেক আগে থেকে প্রস্তুত করাসহ সেক্ষেত্রে দক্ষ ও উপযুক্ত করে তুলতে হবে।
(খ) শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর, নারী, আদিবাসী, ছাত্র, যুবক, সাংস্কৃতিক কর্মী, বস্তিবাসী, সাংবাদিক, আইনজীবী, পেশাজীবী প্রভৃতি অংশের মানুষের প্রগতিশীল গণসংগঠনসমূহের কাজের মাত্রা, পরিধি ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। নানা পন্থায় জনগণের মধ্যে কাজ এবং গণআন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা জোরদার করতে হবে।
(গ) অপরাপর কমিউনিস্ট দল ও শক্তির সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে ও ধৈর্যের সঙ্গে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কমিউনিস্ট ঐক্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হলে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। একইসঙ্গে তাদেরকে নিয়ে গণসংগঠনের ঐক্য গড়ে তোলা এবং সম্ভবমতো ঐক্যবদ্ধ গণসংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টাও চালাতে হবে।
বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ার কাজ
(১) অপরাপর বামপন্থী শক্তি এবং একই সঙ্গে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকেও বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ার কাজে শামিল করতে সচেষ্ট হতে হবে। এসব শক্তিকে ঐক্যের ধারায় টেনে আনার চেষ্টা করতে হবে। একটি-দুটি দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে উঠলে, তাকে রক্ষা ও প্রসারিত করার চেষ্টা করতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের প্রক্রিয়া সহজ-সরল নয়। নানা ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই তাকে সৃজনশীলভাবে ও ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যুগপৎ ও সমন্বিত ধারায় এবং নানা পদ্ধতিতে ও ফর্মে বৃহত্তর বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে সমঝোতা, সমন্বয় ও ঐক্য গড়ে তোলার কাজকে ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। ঐক্য গড়ার এই প্রয়াসকে তৃণমূল পর্যায় থেকেও এগিয়ে নিতে হবে।
(২) সহযোগী বামপন্থী, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক দল ও শক্তির দোদুল্যমানতা, সুবিধাবাদ, বাক্যবাগীশতা, প্রদর্শনবাদ, হঠকারিতা, সংকীর্ণতা প্রভৃতি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ধৈর্যের সঙ্গে সংগ্রাম করার পাশাপাশি, সকলকে তৃণমূলে প্রকৃত শ্রেণিসংগ্রাম ও গণসংগ্রামের কাজে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করার চেষ্টা করতে হবে।
বৃহত্তর শক্তি বলয়
বর্তমানে দেশে যে শক্তি-ভারসাম্য বিদ্যমান তা বিবেচনায় রেখে, বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্পের সম্ভাব্য শক্তি ছাড়াও, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বলয়ের বাইরের দেশপ্রেমিক, উদারনৈতিক, সৎ ও জনপ্রিয় শক্তি এবং ব্যক্তিকে নিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য বৃহত্তর শক্তি-বলয় গড়ার সম্ভাবনাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বুর্জোয়াদের মধ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন
দেশে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সূচনার আগেও, রাজনৈতিক ক্ষমতার নানা উত্থান-পতন ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রশ্নে তার অভিঘাত কী হতে পারে, সেই মানদণ্ডের বিবেচনা থেকে এইসব রাজনৈতিক পর্ব সম্পর্কে মূল্যায়ন করে উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হবে। এসব পরিবর্তনের মুখে, স্বাধীন নীতিনিষ্ঠ অবস্থান বজায় রেখে, মূর্ত-সৃজনশীল কায়দায় এমন কৌশলই কমিউনিস্ট পার্টিকে গ্রহণ করতে হবে, যাতে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে যাত্রা অব্যাহত ও ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হয় বা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়, শাসকগোষ্ঠীর এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, ফ্যাসিস্ট প্রবণতা প্রতিরোধ
বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ার মূল কর্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সশস্ত্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপদ মোকাবেলা করা, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাভূত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা রুখে দাঁড়ানো, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও প্রসারিত করা ইত্যাদি কাজগুলোও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করা এবং গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রসারিত করা বর্তমানে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্তব্য। আগেই বলা হয়েছে যে, এসব ইস্যুতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থী শক্তিকে স্বাধীনভাবে, সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে, লড়াই করতে হবে। তাছাড়াও বিশেষ ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক এ ধরনের ইস্যুতে সম্ভাব্য ব্যাপকতম শক্তিকে শামিল করারও চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনে সাময়িক স্বল্প সময়ের জন্য, দুর্বলতা-দোদুল্যমানতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও, অপরাপর গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক শক্তি বা শক্তি-সমাবেশের সঙ্গে নির্দিষ্ট ইস্যুতে, পরস্পরের স্বাধীন অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে, সমান্তরাল, সম-অভিমুখী, যুগপৎ পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে।
বিভিন্ন মাত্রিকতার এসব কাজ পরস্পর পরিপূরক
বস্তুত, উল্লিখিত এসব নানা মাত্রিকতার কাজ সবই হলো একে অপরের পরিপূরক। সেগুলো সবই হলো মানবমুক্তির অভিমুখে পরিচালিত সংগ্রামের বিভিন্ন অভিপ্রকাশ ও অংশ মাত্র। নীতিতে অটল ও কৌশলে নমনীয় থেকে, ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ার কাজকে মূল কর্তব্য হিসেবে গণ্য করে, সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে বিভিন্ন মাত্রিকতার এসব কাজকে সৃজনশীলতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। এসব বহুমাত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং অন্যান্য গণসংগ্রামকে পার্টির মূল লক্ষ্যাভিমুখে পরিচালনার জন্য উদ্যোগী ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে। আন্দোলনকে খণ্ডিত ইস্যুতে সীমাবদ্ধ না রেখে সবসময় তাকে গভীরতর করা এবং সেসব আন্দোলনের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ইস্যুগুলোকে ক্রমে ও উপযুক্তভাবে যুক্ত করে ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ার প্রয়াসকে পরিপুষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে।
আহ্বান
দেশের এই সংকটময় সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে সাম্রাজ্যবাদ, লুটপাটতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে এবং রুটি-রুজি, ভাত-কাপড়ের দাবি আদায়ের জন্য ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে তীব্র গণসংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে। এই সংগ্রামের সাফল্যের স্বার্থে কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করার জন্য এবং বিকল্প গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্যও দেশবাসীর প্রতি পার্টি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।
Login to comment..