রাজনীতি যখন কেনাবেচা, ভাগবাটোয়ারা, আখের গোছানো এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, সেখানে নীতির প্রশ্নে আপসহীন থেকে শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি মানুষের পার্টি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) মানুষ ও প্রকৃতির মুক্তির লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মর্যাদা, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। সিপিবির ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
আজ ৬ মার্চ ২০২৪ বুধবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর পুরানা পল্টনস্থ মুক্তিভবনের সামনে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আল। বক্তব্য রাখেন, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ। এসময় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহীন রহমান, অধ্যাপক এ এন রাশেদা, পরেশ কর, সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রেজা, কোষাধ্যক্ষ ডা. ফজলুর রহমানসহ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ঢাকাস্থ সদস্যবৃন্দ সহ পার্টির শত শত প্রবীণ, নবীন, নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সিপিবি সবচেয়ে আপসহীন ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে যোগ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর এই শক্তি ও দৃঢ়তা অর্জন করেছে তার ৭৬ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।
তিনি বলেন, বেআইনি থাকার পরেও পাকিস্তানের দীর্ঘ শাসন ও শোষণবিরোধী লড়াইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। ঐ সময় নানাভাবে কমিউনিস্টদের হত্যা
করা হয়। ১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট রাজবন্দিদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা ছিল প্রথম জেল হত্যা। কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে যুগে যুগে ষড়যন্ত্র হয়েছে, পার্টিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি বরং তারাই ধ্বংস হয়েছে। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, দুর্নীতি-লুটপাট রুখে দাঁড়াতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনসহ দেশের সকল শ্রেণিপেশার আন্দোলনে সিপিবি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমরা বাংলাদেশে অনেক কিছুই দেখলাম। এখন রাজনীতি দুর্বৃত্তদের হাতে বন্দি। এরাই পালাক্রমে ক্ষমতা দখল করে আছে। এদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। একই সাথে গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাটতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ করে তুলতে হবে ।
তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টিই একমাত্র জনগণের পক্ষের শক্তি এবং প্রকৃত বিরোধীদল। কারণ নীতির প্রশ্নে আমরাই তাদের বিরোধিতা করি এবং জনগণের পক্ষে কথা বলি ।
সিপিবির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ক্ষমতায় গেলে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সব মানুষের ভোটাধিকার-গণতন্ত্র-কাজ-শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে কমিউনিস্ট পার্টি। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যারা পালাক্রমে শাসন ক্ষমতায় ছিল এবং আছে তারা মেহনতি মানুষকে
অমর্যাদায় রেখেছে। সমভোটের অধিকারের কথা থাকলেও ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এক ভোটে সবার সমান অধিকার থাকলেও যেসব মেহনতি মানুষের শ্রমে-ঘামে অর্থ বিত্ত গড়ে উঠেছে তারা আজ আধপেটা খেয়ে, নিজের সন্তানকে চিকিৎসা-শিক্ষা দিতে না পেরে দিন অতিবাহিত করছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নীতিহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির পতাকা তলে সমবেত হতে হবে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাটতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকার পাচারের টাকা উদ্ধার, খেলাপী ঋণ আদায় ও দুর্নীতি লুটপাট বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয় না। রাস্তাঘাট, হাটবাজারে ইজারা, ভূমি অফিসের দূর্নীতি, চাঁদাবাজি দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
মহাজোট সরকারের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ও এদের স্থানীয় দুর্বৃত্ত চক্রের হাতে সাধারণ মেহনতি মানুষ বন্দী। জীবনের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারছে না। তাই আজ মানুষ হিসাবে মেহনতি মানুষকে যার যার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণ আন্দোলন, গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনরা দেশটাকে আজ এমন জায়গায় নিয়ে গেছে, তরুণ প্রজন্ম দেশকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে না । তথ্যই বলছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণ কাজ না করে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার চিন্তায় বিভোর তারা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এটি কাম্য হতে পারে না। কমিউনিস্ট বামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলে মানুষের মর্যাদা, সম্পদের সুষম বন্টন, সকলের শিক্ষা, চিকিৎসা, কাজ ও
নতুন প্রজন্মের সামনে সবার উপযোগী বাংলাদেশ গড়ে তোলার দৃশ্যমান কাজ করবে।
তিনি সরকারের ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, কিছু ব্যবসায়ী ও কমিশন ভোগীদের সুযোগ দিতেই বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থাকার পরও জ্বালানিখাতকে জাতীয় অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের গলার কাটায় পরিণত করা হয়েছে। সরকারের এই ভুলনীতি ও দুর্নীতির দায় জনগণের কাধে চাপিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এটা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না।
তিনি গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিনা ভোটে নির্বাচিতরা কখনোই জনগণের স্বার্থে কাজ করবে না। তাদের জবাবদিহিতা থাকবে না। স্বচ্ছতা থাকবে না। তাই মেহনতি মানুষকে নিজেদের দাবির সাথে সাথে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে শরিক হতে হবে।
সমাবেশ শেষে একটি বর্ণাঢ্য লাল পতাকা মিছিল পুরানো পল্টন, দৈনিক বাংলা, মতিঝিল, দিলকুশা, গুলিস্তান, প্রেসক্লাব হয়ে পার্টি কার্যালয়ে এসে শেষ হয়।
সমাবেশের পূর্বে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। এ সময়ে জাতীয় সংগীত, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল পরিবেশন করা হয়। এর আগে গণসংগীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীবৃন্দ।
৭৬তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আজ ঢাকার বিভিন্ন থানাসহ সারাদেশের জেলা সদর ও উপজেলা, থানায় পার্টি কার্যালয়ের সামনে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সমাবেশ-র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।